ক্ষুধার্ত শিশুদের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন আফগানরা
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
আফগান বাবা-মায়েরা তাদের ক্ষুধার্ত শিশুদের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখছেন যেন তাদের ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করতে না হয়। এছাড়া অনেক আফগান বেঁচে থাকার জন্য নিজেদের মেয়েদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। আবার কেউ কেউ শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও বিক্রি করে দিচ্ছেন। তালেবানরা ক্ষমতা দখলের পর আরেকটি কঠিন শীতকালের মুখোমুখি হচ্ছে আফগানিস্তানের অসহায় দরিদ্র মানুষ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দেশটির রিজার্ভের অর্থ আটকে রাখার কারণে অর্থনৈতিকভাবে বিপর্যস্ত আফগানিস্তান দুর্ভিক্ষের কবলে পড়তে যাচ্ছে।
আফগান শিশু
আব্দুল ওয়াহাব নামের একজন আফগান বলেছেন, 'আমাদের খাবার নেই। আমাদের বাচ্চারা কাঁদছে, ক্ষুধার জ্বালায় তারা ঘুমাতেও পারে না। এজন্য আমরা ফার্মেসিতে গিয়ে ওষুধ নিয়ে আসি। বাচ্চাদের তা খেতে দেই যেন তারা ঘুমিয়ে যেতে পারে।' আফগানিস্তানের তৃতীয় বৃহত্তম শহর হেরাতের বাইরে অসংখ্য মাটির ঘরের একটিতে বাস করেন নিরুপায় এই পিতা। যুদ্ধ এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে বাস্তুচ্যুত হাজার হাজার মানুষ এসব ছোট ছোট ঘরে দশকের পর দশক ধরে বাস করে আসছেন।
আব্দুল ছাড়াও ওই এলাকার অনেক বাবা-মাই সন্তানদের ঘুম পাড়িয়ে রাখার জন্য ওষুধ দিতে বাধ্য হচ্ছেন। গোলাম হযরত তার জামার পকেট থেকে এক পাতা ওষুধ বের করে দেখালেন। এগুলো ছিল এলপ্রাজোলাম। সাধারণত উদ্বেগজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়।
গোলাম হযরতের ছয় সন্তান রয়েছে। সবচেয়ে ছোটটির বয়স এক বছর। এতটুকু একটা বাচ্চাকেও এই ওষুধ দিয়েছেন তিনি। অন্যরা এসসিটালোপ্রাম এবং সারট্রালাইন এর মতো ওষুধও শিশুদের খাওয়াচ্ছেন। সাধারণত বিষন্নতা এবং উদ্বেগ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য এই ওষুধ ব্যবহার করা হয়। অথচ নিরুপায় হয়ে আফগানরা তাদের সন্তানদের খাওয়াচ্ছেন এসব ওষুধ।
এদিকে চিকিৎসকরা জানাচ্ছেন, অপুষ্টির শিকার অল্পবয়সি শিশুদের এই জাতীয় ওষুধ দেওয়া হলে লিভারের ক্ষতির পাশাপাশি দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, ঘুম এবং আচরণগত সমস্যা দেখা দিতে পারে।
স্থানীয় ফার্মেসিতে দেখা গেছে ১০ আফগানির (আফগানিস্তানের মুদ্রা) বিনিময়ে ৫টি ট্যাবলেট পাওয়া যায়। এই অর্থ দিয়ে হয়তো এক টুকরো রুটি কিনতে পারা যাবে। বেশিরভাগ আফগান পরিবারই প্রতিদিন কয়েক টুকরো রুটি পরিবারের সদস্যদের সাথে ভাগাভাগি করে খান। একজন নারী জানিয়েছেন, সকালে তারা শুকনো রুটির কিছু অংশ খেয়েছেন বাকিটুকু রাতে খাওয়ার জন্য ভিজিয়ে রেখেছেন।
হেরাতের বাইরের এলাকার বেশিরভাগ পুরুষই দিনমজুরি করেন। বছরের পর বছর ধরে তারা কঠিন জীবনযাপন করছেন। গত আগস্টে তালেবানরা আফগানিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। কিন্তু তালেবান সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি না থাকায় বিদেশি তহবিল আসা স্থগিত হয়ে যায়। ফলে দেশটিতে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের শুরু হয়। কাজের অভাবে বেশিরভাগ পুরুষই বেকার বসে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। ভাগ্য ভাল হলে কোনো দিন হয়তো কেউ কেউ কাজ খুঁজে পান। সে সময় ১০০ আফগানি বা এক ডলারের চেয়ে কিছু বেশি অর্থ আয় করেন তারা।
আফগানিস্তানের সর্বত্রই দেখা গেছে, মানুষ তাদের পরিবারকে ক্ষুধা থেকে বাঁচাতে চরম পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হচ্ছেন। আম্মার(ছদ্মনাম) নামে একজন জানান, তিন মাস আগে তিনি নিজের কিডনি বিক্রি করার জন্য অপারেশন করেছেন। আম্মারের পেটজুড়ে ৯ ইঞ্চির একটি সেলাইয়ের দাগ দেখা যাচ্ছিল। মাত্র বিশের কোঠায় বয়স এই তরুণের। তিনি বলেছেন, নিতান্ত নিরুপায় হয়েই স্থানীয় একটি হাসপাতালে কিডনি বিক্রি করেছেন। অসহায় এই তরুণ বলেন, ‘তারা কিছু পরীক্ষা করেছে, তারপর তারা আমাকে এমন কিছু দিয়ে ইনজেকশন দিয়েছে যা আমাকে অজ্ঞান করে দিয়েছে। আমি ভয় পেয়েছিলাম কিন্তু আমার কাছে কোন বিকল্প ছিল না।'
কিডনি বিক্রি করে ২ লাখ ৭০ হাজার আফগানি বা ৩ হাজার ১০০ ডলার পেয়েছিলেন আম্মার। পরিবারের জন্য খাবার কেনা এবং ধার শোধ করতে গিয়েই বেশিরভাগ অর্থ শেষ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমরা যদি এক রাতে খাই, পরের দিন খাই না। কিডনি বিক্রি করার পর, নিজেকে অর্ধেক মানুষ মনে হয়। আমি হতাশ বোধ করি। জীবন এভাবে চলতে থাকলে, আমার মনে হয় কোনো একদিন আমি মারাও যেতে পারি।'
অর্থের জন্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিক্রি করা আফগানিস্তানে নতুন কোনো ঘটনা নয়। তালেবানরা ক্ষমতায় আসার আগেও আফগানরা দারিদ্র্যের কারণে নিজেদের শরীরের অঙ্গ বিক্রি করে দিতেন। কিন্তু এখন এত বড় বেদনাদায়ক পদক্ষেপ নেওয়ার পরেও মোটামুটি খেয়ে পরে বাঁচার মত অবস্থাও তাদের নেই। বেঁচে থাকার জন্য আর কী করতে হবে তা ভেবে কুল পাচ্ছেন না অসহায় এসব মানুষ।
একজন তরুণী মা জানিয়েছেন, ৭ মাস আগে তিনি কিডনি বিক্রি করে দিয়ে ২ লাখ ৪০ হাজার আফগানি বা ২ হাজার ৭০০ ডলার পেয়েছিলেন। কিন্তু এই অর্থ তিনি যথেষ্ট বলে মনে করছেন না। কারণ ভেড়ার পাল কেনার জন্য তার পরিবার যে পরিমাণ অর্থ ধার হিসেবে নিয়েছিল তা শোধ করতেই বেশিরভাগ টাকা খরচ হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে বন্যার কারণে এই পরিবারের পালা ভেড়ার পাল মারা যাওয়ার পর তারা জীবিকা নির্বাহ করার উপায় হারিয়ে ফেলেছিলেন।
তরুণী এই মা ভেজা চোখে বলেন, 'আমি এখন আমাদের দুই বছরের মেয়েকে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি। আমরা যাদের কাছ থেকে ধার নিয়েছি তারা প্রতিদিন আমাদেরকে হয়রানি করে। শোধ করতে না পারলে মেয়েকে তাদের কাছে দিয়ে দেওয়ার জন্য জোরাজুরি করে।' তার স্বামী বলেন, 'আমাদের অবস্থা দেখে আমি খুব লজ্জা পাই। মাঝে মাঝে আমার মনে হয় এভাবে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াও ভাল।'
আফগানরা এখন তাদের মেয়েদের বিক্রি করে দিতে বাধ্য হচ্ছেন। নিজামুদ্দিন নামের একজন কান্নাজড়িত গলায় বলেন, ‘আমি আমার পাঁচ বছরের মেয়েকে ১ লাখ আফগানিতে বিক্রি করেছি।'
আব্দুল গাফার নামের আরেকজন বলেন, ‘আমরা বুঝি এটা ইসলামিক আইনের পরিপন্থী, এবং আমরা আমাদের বাচ্চাদের জীবনকে বিপদের মধ্যে ফেলছি। কিন্তু এছাড়া অন্য কোন উপায় নেই।' ক্ষুধার যন্ত্রণায় মানুষ হিসেবে স্বাভাবিক মর্যাদাটুকুও হারিয়ে ফেলেছেন অসহায় এসব বাবা-মা। জাতিসংঘও জানিয়েছে, আফগানিস্তানে এখন মানবিক বিপর্যয় চলছে।
হেরাতে তালেবানের প্রাদেশিক সরকারের মুখপাত্র হামিদুল্লাহ মোতাওয়াকিলের কাছে বিবিসির প্রতিবেদক জানতে চান, ক্ষুধা মোকাবেলায় তারা কী করছেন। তিনি বলেন, 'আফগানিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা এবং আফগানিস্তানের সম্পদ জব্দ করার ফলে এ ধরনের পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। আমাদের সরকার অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করার চেষ্টা করছে।' তবে তিনি অভিযোগ করেন, অনেকেই সরকারি সাহায্য পাওয়ার আশায় নিজেদের অবস্থা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছেন।
এদিকে আফগানদের অভিযোগ, তালেবান এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের পরিত্যাগ করেছে। ক্ষুধা একটি ধীর এবং নীরব ঘাতক। এর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান হয় না। আফগানিস্তানের সংকটের মাত্রা বিশ্ববাসীর কাছে সত্যিকার অর্থে হয়তো প্রকাশ নাও পেতে পারে। কারণ তাদের নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা আছে বলে আপাতত মনে হচ্ছে না।
সূত্র: বিবিসি
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.