তুরস্কে উদ্ধারকাজে ‘আনসাং হিরো’ খনি শ্রমিকরা

ভূমিকম্পে তুরস্কের বিস্তীর্ণ এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। সেই ধ্বংসস্ত‍ূপ থেকে হতাহতদের উদ্ধারে এগিয়ে এসেছে বিভিন্ন দেশের স্বেচ্ছাসেবীরা। তবে সবার আগে এ উদ্ধারকাজে যারা এগিয়ে এসেছিল, সবচেয়ে বিপজ্জনক জায়গায় ঢুকে উদ্ধারকাজ চালিয়েছিল, তারা ছিল সেখানকারই খনি শ্রমিক। তাদেরকে এখন ‘আনসাং হিরো’ বলে অভিহিত করা হচ্ছে।

এরহান আক্কুস

গত ৬ ফেব্রুয়ারি তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় আঘাত হানা দুটি পরপর শক্তিশালী ভূমিকম্পে এ পর্যন্ত ৪৩ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। অধিকাংশ মানুষ ঘুমে থাকায় ভোরে আঘাত হানা এ ভূমিকম্পে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় অনেক বেশি প্রাণঘাতি বিবেচিত হয়।

ভূমিকম্পে ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত হওয়ার সময় অনেক মানুষ সেখানে আটকে যায়। তাদের উদ্ধারে দেশ-বিদেশ থেকে বহু স্বেচ্ছাসেবী এগিয়ে আসে। কিন্তু সবার আগে সেখানে পৌঁছেছিলেন খনি শ্রমিকরা। ভূমিকম্পের পরদিন থেকেই তারা পুরোদমে উদ্ধারকাজে নেমে পড়েন। দ্রুত শুরু করতে পারায় তারা অনেক জীবিত মানুষকে উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন।

উদ্ধার কাজে অংশ নেওয়া ৪৭ বছর বয়সী খনি শ্রমিক এরহান আক্কুস বলেন, তারা সারা জীবন যে কাজ করে যাচ্ছিলেন, তাতে কাজের প্রশংসা বা স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন যাপন করা দুটোই বিরল। প্রতিদিন নিরাপত্তা হেলমেট, ফ্লাশলাইট ও হাতুড়ি নিয়ে খনিতে নেমে যাওয়া এবং দিন শেষে সেখান থেকে বাড়ি ফিরে যাওয়া তাদের রুটিনে পরিণত হয়েছিল।

কিন্তু তাদের এই কাজই তুরস্কের ভূমিকম্পে বহু মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছে। খনিতে কাজ করার মতো করে তারা অবলীলায় ঢুকে পড়েছেন ধ্বংসস্তূপের মাঝে। মানুষের ডাকে সাড়া দিয়ে অনায়াসে ঢুকে পড়েছেন হেলে পড়া ভবনে। অন্য উদ্ধারকারীরা যখন ব্যাকরণ মেনে উদ্ধার কাজ চালাছিলেন, তখন খনিতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থাকায় তারা সহজে ধ্বংসস্তুপের ভেতর থেকে জীবিত লোকজনকে উদ্ধার করেছিলেন। মরদেহ উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছেন আত্মীয়দের কাছে।

এরহান আক্কুস জানান, তারা রাষ্ট্র পরিচালিত একটি কয়লা খনিতে কাজ করতেন। ভূমিকম্পের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় উদ্ধার কাজের জন্য তাদেরকেই সর্বপ্রথম নিয়োগ করা হয়। অন্যান্য সব সংস্থার আগেই তারা সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হাতায়ে পৌঁছেন।

তিনি বলেন, আরও ৭৪ জন খনি শ্রমিকের সাথে আমি রোনেসান রেজিডানস নামে পরিচিত একটি বহুতল ভবনে আটকে পড়া উদ্ধার কাজে অংশ নিই। আমাদের কাছে বিশেষ কোনো সরঞ্জাম ছিল না। তারপরও আমরা হাতে ধ্বংসাবশেষ সরিয়ে মানুষকে উদ্ধার করেছি।

এরহান বলেন, একবার আমাদেরকে ৪৫ ডিগ্রি হেলে পড়া একটি ভবনে উদ্ধার কাজ চালাতে নিয়ে যাওয়া হয়। কোনো ভবন পুরোপুরি মাটির সাথে লেগে গেলে বা মাটিতে পড়ে গেলে তাতে উদ্ধার কাজ চালানো সহজ। কিন্তু হেলে থাকা ভবনে সেভাবে উদ্ধারকাজ চালানো যায় না। অথচ ওই ভবনের ভেতর থেকে আটকে পড়া লোকদের চিৎকার ও কান্নার শব্দ ভেসে আসছিল। তখন আমরা খনির টানেলে কাজ করার অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে বাকাভাবে হেলে পড়া ওই ভবনে উদ্ধার কাজ চালাই। আমরা সেখান থেকে ৮ বছর বয়সী এক মেয়ে ও তার মাকে উদ্ধার করি। তবে ওই মেয়েটির বাবা ততক্ষণে মারা গিয়েছিলেন। আমরা তার মরদেহওটিও উদ্ধার করি।

দশ বছর ধরে খনিতে কাজ করা এরহান আক্কুস বলেন, শুধু আমি নই। আমার মতো আরও বহু খনি শ্রমিক অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে ধ্বংসস্তূপ থেকে হতাহতদের উদ্ধার করতে। আমরা ছেঁড়া প্যান্ট ও ছেঁড়া বুট পরেই দিনের পর দিন উদ্ধার চালিয়ে গেছি। এমনকি অন্ধকারের মধ্যেও আমরা আমাদের কাজ অব্যাহত রেখেছি।

তিনি বলেন, সাত দিনে আমরা মাত্র চার ঘণ্টা ঘুমানোর সুযোগ পেয়েছি। আমরা নিজেরাই আমাদের থাকার জায়গা ও অস্থায়ী টয়লেট তৈরি করেছিলাম। সাত দিন পর যখন আমাদের কাজ শেষ হয় তখন আমাদের আঙ্গুল ফুলে গিয়েছিল।