কাবা শরীফ: প্রথম দেখায় যা বলেছিলেন বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বতুতা

দশম হিজরি তথা ৬৩২ সালে অনুষ্ঠিত হয়েছিল বিদায় হজ। তারপর থেকে বিভিন্ন সময় লাখ লাখ মুসল্লি হজ পালন করেছেন। যুগ যুগ ধরে এসব হজযাত্রীর অনেকেই লিখে রেখেছেন নিজেদের হজ সফরের কথা। চৌদ্দ শতাব্দীর মরক্কোর প্রসিদ্ধ পরিব্রাজক ইবনে বতুতাও নিজের কলমে রেখে গেছেন হজের স্মৃতি। মজার কথা হলো, প্রথমবার যখন তিনি কাবা শরীফ দেখেছিলেন, তার কাছে মনে হচ্ছিল, এটি যেন কোনো এক নববধূ। তার লিখিত ভ্রমণগ্রন্থ ‘আর-রিহলা’তে পাওয়া গেছে এ তথ্য।

ইবনে বতুতা ও তার মক্কার সফরবৃত্তান্ত

পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম হিজরি শতাব্দীতে মরক্কোর আমির-ওমরাহসহ সব শ্রেণির মধ্যেই মক্কা-মদিনা সফরের সফরের একটা বিশেষ ঝোঁক তৈরি হয়। তবে তখন শুধু হজের জন্যই এ যাত্রা হতো না, ইলম অর্জনের জন্যও অনেকে সফর করতেন। তারই ধারাবাহিকতায় ইবনে বতুতাও ৭২৫ হিজরিতে হজের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। কিন্তু তৎকালীন রাজধানী তানজা ত্যাগ করলেও দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে তিনি সে বছর আর মক্কা-মদিনায় পৌঁছতে পারেননি। বরং পরের বছর ৭২৬ হিজরিতে শামের কাফেলার সাথে দামেশক হয়ে মদিনায় পৌঁছান তিনি। কয়েকদিন সেখানে অবস্থান করে পা রাখেন মক্কায়।

৭২৬ হিজরির ২০ জিলকদ জীবনে প্রথমবারের মতো বায়তুল্লাহ শরিফের দর্শন পান ইবনে বতুতা। আল্লাহর ঘরের প্রথম দর্শনে তিনি বিহ্বল হয়ে পড়েন। ভ্রমণকাহিনীতে তিনি লেখেন, আমার পরম সৌভাগ্য, আমি কাবা শরিফ দেখলাম! এ তো যেন এক নববধূ! মহত্বের মঞ্চে অধিষ্ঠিত কাবা যেন সৌন্দর্যের কাজল মেখে কাপড় জড়িয়ে গর্বিত পদক্ষেপে হাঁটছে। দয়াময়ের প্রতিনিধি দ্বারা বেষ্টিত এই বায়তুল্লাহ আমাদের পৌঁছে দেবে রিদওয়ান জান্নাতে।

ইবনে বতুতার ভ্রমণকাহিনী আর-রিহলা

হজের প্রতিটি ধাপ পালন তার মধ্যে অবর্ণনীয় এক বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। তাওয়াফ, কুদুম ও সাফা-মারওয়ার সায়ী করে বলেন, এসব আহকামের এমনই মাহাত্ম্য, হৃদয় উড়ে চলে যেতে চায়, মহান প্রভুর কাছে আশ্রয় নিতে চায়। এখানে যে আসবে তার তনু-মনের সবটুকুই যেন হারিয়ে ফেলবে। তার সবকিছুই যেন ছিনতাই হয়ে যাবে। ইব্রাহিমের (আ.) দোয়ায় এ মোবারক ভূমি চোখের মণি ও হৃদয়ের শীতলতায় পরিণত হয়েছে।

বায়তুল্লাহ শরিফের মাহাত্ম্য বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি লেখেন, বায়তুল্লাহ শরিফের সাক্ষাতে সফরের ক্লান্তি ও কষ্ট বিলীন হয়ে যায়। কত দুর্বল মানুষ তোমাকে দেখার জন্য মৃত্যুর চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। তারপর তোমাকে যখন তারা দেখে, তখন তারা এতটাই তারা আনন্দিত ও বিমোহিত হয় যেন কখনো কোনো কষ্ট তাদের স্পর্শও করেনি।

মক্কার আবহাওয়া রুক্ষ হওয়া সত্বেও সেখানে খাবার ও ফল-ফলাদির প্রাচুর্য নিয়ে ইবনে বতুতা বলেন, আমি সেখানে এমন সব আঙ্গুর, তীন, পীচ, তরমুজ ও খেজুর খেয়েছি, যার তুলনা পৃথিবীর কোথাও নেই। পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা সেরা খাদ্য-ভাণ্ডার এই মক্কা।

সে সময় কোরবানীর তৃতীয় দিন কাবার গিলাফ পরিবর্তন করা হতো। সে চিত্র তুলে ধরে তিনি লেখেন, কাবার অভিভাবক বনু শায়বাহ কাবার গিলাফ পরিবর্তন করেন। সে গিলাফের চতুর্দিকে সাদা অক্ষরে কুরআনের বিভিন্ন আয়াত লেখা। মামলুক সুলতান নাসির মুহাম্মাদ বিন কালাওন নিজেই কাবার গিলাফ পরিবর্তনের পুরো কাজ তদারকি করতেন।

হজের স্মৃতিতে তিনি তৎকালীন ইরাকি কাফেলার দান-দক্ষিণার কথাও অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি সে সময় ইরাকি কাফেলাকে মক্কার দরিদ্রদের দুই হাতে স্বর্ণ দান করতে দেখেছিলেন। ইবনে বতুতা বলেন, তাদের দানের মাত্রা এত বেশি ছিল যে, মক্কায় বিভিন্ন কিছুর দান ব্যাপকভাবে হ্রাস পেয়ে যেত।

ইবনে বতুতার বিভিন্ন লেখনি থেকে জানা যায়, তিনি মোট তিনবার হজ করেছিলেন। একাধারে ২৩ বছর তিনি বিশ্বভ্রমণে ব্যস্ত থেকেছেন। এসব সফরের কথা তিনি লিপিবদ্ধ করেছেন। তুলে ধরেছেন বিম্বের বিভিন্ন দেশের হাল-চাল। সেই সফরনামার বদৌলতে তিনি পৃথিবীতে অমর হয়ে আছেন।

মিডলইস্টআই অবলম্বনে