দেশব্যাপী বিক্ষোভে সংঘর্ষে নিহত ৪২

রোববার সারা দেশের ১৪টি জেলায় বিক্ষোভকারী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য এবং ক্ষমতাসীন দল সমর্থিত সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে ৪২ জন নিহত হয়েছেন।

ছবি - সংগৃহীত

নিহতদের মধ্যে ঢাকা মহানগরী ও জেলায় চারজন, ফেনী ও নরসিংদীতে ছয়জন করে, পাবনা, মাদারীপুর, রংপুর, সিরাজগঞ্জ, কিশোরগঞ্জ ও বগুড়ায় তিনজন করে, মুন্সীগঞ্জ, কুমিল্লা ও সিলেটে দুইজন করে এবং ঝালকাঠি ও বরিশাল জেলায় একজন করে রয়েছেন।

জেলা প্রশাসন, পুলিশ, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এবং স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এই মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

ফেনী: ফেনী জেলা প্রতিনিধি জেলা সদর হাসপাতাল সূত্রে জানান, রোববার বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে পাঁচজন নিহত হন। নিহতদের মধ্যে দুই শিক্ষার্থী সাগর (১৮) এবং ইশতিয়াক আহমেদ শ্রাবণ (১৯) রয়েছেন।

নরসিংদী: নরসিংদী প্রতিনিধি মাদবদী পৌরসভার ২ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর রাজিব আহমেদের বরাত দিয়ে জানান, সংঘর্ষে ছয়জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন চরদিঘলদী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান দেলোয়ার হোসেন, নরসিংদী সদর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের ছোট ভাই দেলোয়ার, যুবলীগ নেতা নাদি মনির এবং শ্রমিক লীগ নেতা আনিসুর রহমান। মাদবদীতে নিহত সকলেই আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন।

ওয়ার্ড কাউন্সিলর স্থানীয়দের বরাত দিয়ে বলেন, মাদবদী পৌরসভা কার্যালয়ের সামনে আওয়ামী লীগের লোকজন বিক্ষোভকারীদের ওপর হামলা চালায় এবং গুলি চালায়। এতে চার বিক্ষোভকারী গুরুতর আহত হন। এরপর ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা ও বিক্ষোভকারীরা আওয়ামী লীগের লোকজনকে ঘেরাও করে। তারা মাদবদী বাজার বড় মসজিদে আশ্রয় নিলে সেখানে তাদেরকে হত্যা করা হয়।

বগুড়া: জেলা সিভিল সার্জন জানান, জেলায় সংঘর্ষে একজন নিহত হয়েছেন। রোববার বগুড়া পুলিশ লাইনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ বারবার কাঁদানে গ্যাসের শেল নিক্ষেপ করে। এতে পুরো এলাকা কাঁদানে গ্যাসে ছেয়ে যায়।

ঝালকাঠি: জেলা প্রশাসক সালেহীন তানভীর গাজী রোববার একজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।

সিলেট: সিলেট প্রতিনিধি গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা শাহীন আহমেদের বরাত দিয়ে জানান, উপজেলায় সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে দুইজন নিহত হয়েছেন। নিহতরা হলেন তাজউদ্দিন (৪৩) ও সানি আহমেদ (১৮)।

ঢাকা: ঢাকায় পৃথক ঘটনায় দুইজন নিহত হয়েছেন। ঢাকা হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ বাচ্চু মিয়া জানান, হাবিবুল্লাহ বাহার কলেজের বিবিএ দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ সিদ্দিকী (২০) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। তার বন্ধু বুয়েট শিক্ষার্থী জহুরুল ইসলাম বলেন, আব্দুল্লাহকে শহরের জিগাতলা এলাকায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলিতে আঘাত করা হয়েছিল। কুর্মিটোলা হাসপাতালের পরিচালক সাঈদুর রহমান জানান, গুলিবিদ্ধ এক ব্যক্তিকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়েছে।

কুমিল্লা: কুমিল্লা প্রতিনিধি দেবিদ্বার থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নয়ন মিয়ার বরাত দিয়ে জানান, দেবিদ্বার উপজেলার নিউমার্কেট এলাকায় সংঘর্ষে কুমিল্লার বারপুর গ্রামের বাসচালক মো. রুবেল মিয়া (৩৪) নিহত হন।

রংপুর: রংপুরের জেলা প্রশাসক মোবারক হোসেন জেলায় তিনজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। তিনি তবে নিহতদের বিস্তারিত পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি। তিনি বলেন, নিহতদের মধ্যে আওয়ামী লীগ সমর্থিত একজন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং তার দেহরক্ষী রয়েছেন।

কিশোরগঞ্জ: কিশোরগঞ্জের জেলা প্রশাসক মো. আবুল কালাম আজাদ বলেন, দুপুর ১২টার দিকে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম টিটুর বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। এতে দুইজন পুড়ে মারা যান। আরেকজন হাসপাতালে মারা যান। তিনি কারো পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি।

সিরাজগঞ্জ: ইউনাইটেড নিউজ অব বাংলাদেশের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ডাকে চলমান 'সর্বাত্মক অসহযোগিতা'র মধ্যে সিরাজগঞ্জে বিক্ষোভকারী, আওয়ামী লীগ কর্মী ও পুলিশের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনায় কমপক্ষে চারজন নিহত এবং অসংখ্য আহত হয়েছেন। এছাড়াও, জেলায় ব্যাপক ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ এবং দুই আইনপ্রণেতার বাড়িতে হামলার ঘটনা ঘটেছে। ইউএনবি'র স্থানীয় প্রতিনিধি জানান, নিহতদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে জানা যায়নি। তাদের মরদেহ উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে।

স্থানীয় এবং প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, বিক্ষোভকারীরা প্রথমে সদর উপজেলার এসএস রোডে জড়ো হয় এবং সকাল ১১টার দিকে জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে হামলা চালায়।

প্রতিনিধিরা জানান, যখন আওয়ামী লীগের লোকজন বিক্ষোভকারীদের প্রতিহত করার চেষ্টা করে তখন সংঘর্ষ শুরু হয় এবং ঘটনাস্থলেই একজন নিহত হন। এর পরপরই সদর উপজেলার বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এতে আরও তিনজন নিহত এবং অনেকে আহত হন।

বিক্ষোভকারীরা সিরাজগঞ্জ-২ ও ৬ আসনের সংসদ সদস্য আওয়ামী লীগ নেতা মো. হাবিব মিল্লাত এবং মেরিনা জাহানের বাসভবনে ভাঙচুর চালায় এবং আগুন ধরিয়ে দেয়।

এছাড়াও জেলা প্রশাসক ও সদর উপজেলার সহকারী কমিশনারের কার্যালয়ে ভাঙচুর চালানো হয়। এছাড়াও বেশ কয়েকটি পুলিশ ফাঁড়ি এবং হাটিকুমরুল হাইওয়ে পুলিশ থানায় হামলা চালানো হয়। এছাড়াও বিক্ষোভকারীরা বেলকুচি পুলিশ থানা ঘেরাও করে রাখে।

পাবনা: রোববার দুপুরে পাবনা শহরে বিক্ষোভকারী ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে এক শিক্ষার্থীসহ তিনজন নিহত এবং ১৬ জন আহত হয়েছেন।

নিহতদের মধ্যে দুইজন হলেন পাবনার সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থী জাহিদুল ইসলাম (১৯) এবং মাহফুজুল আলম (১৬)।

পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম দুই যুবকের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন। পাবনা জেনারেল হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম আরও একজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন যার পরিচয় এখনও শনাক্ত করা যায়নি।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, দুপুর ১২টার দিকে সরকারি এডওয়ার্ড কলেজের শিক্ষার্থীরা কলেজ থেকে একটি মিছিল বের করে পাবনা শহরের ট্রাফিক ইন্টারসেকশন এলাকায় যায়।

অভিযোগ রয়েছে, ট্রাফিক ইন্টারসেকশন এলাকায় আওয়ামী লীগ কর্মীরা তাদের ওপর গুলি চালায়।

পরে পুলিশ কাঁদানে গ্যাস এবং রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করে দেয়।

হাসপাতালের সহকারী পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, আহতদের যখন পাবনা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন জাহিদুল ও মাহফুজুলকে মৃত ঘোষণা করা হয়।

তিনি বলেন, গুলিবিদ্ধ হয়ে আটজনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে একজন চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

মুন্সীগঞ্জ: রোববার সকালে মুন্সীগঞ্জ শহরের সুপারমার্কেট এলাকায় বিক্ষোভকারী, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের যুব সংগঠন যুবলীগের কর্মীদের মধ্যে সংঘর্ষে কমপক্ষে দুইজন নিহত এবং সাতজন গুলিবিদ্ধ হয়েছেন।

তাৎক্ষণিকভাবে নিহতদের পরিচয় জানা যায়নি।

ঘটনাটি কভার করার সময় নিউ এইজের মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি মো. মইনুদ্দীন আহমেদ শুভ্রর ওপর ক্ষমতাসীন দলের কর্মীরা নির্যাতন চালায়। শহরে উত্তেজনা বিরাজ করছে।

মাদারীপুর: রোববার মাদারীপুরে বিক্ষোভকারী ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে সংঘর্ষে এক অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি নিহত হন। মাদারীপুর জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক মোহসিন উদ্দিন ফকির এই খবর নিশ্চিত করেছেন।

শনিবার ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে এক সমাবেশে বিক্ষোভরত শিক্ষার্থীরা সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করার পর রোববার সারাদেশে এই সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। এর আগে তারা জুলাই মাসে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত ২০০ জনেরও বেশি মানুষের বিচারের দাবিতে নয় দফা দাবি আদায়ের দাবিতে আন্দোলন করে আসছিল।

শনিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষ থেকে আলোচনার আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়কদের একজন নাহিদ ইসলাম সরকারের পদত্যাগের এক দফা দাবি ঘোষণা করেন।

নিউএজ অবলম্বনে