অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের ১১ দফা সুপারিশ

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বেশ কিছু দীর্ঘমেয়াদী সুপারিশ পেশ করেছে, যার মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। শনিবার সকাল ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের মোজাফ্‌ফর আহমদ চৌধুরী অডিটোরিয়ামে `অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে আমাদের কী চাওয়া?' শীর্ষক এক আলোচনা সভায় এসব দাবি উত্থাপন করা হয়।

ছবি - সংগৃহীত

শিল্পকর্ম, উপাসনালয়, মাজার এবং ভাস্কর্যের ওপর হামলা প্রতিরোধ ও বিচারের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি পুনরুদ্ধারে ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণেরও আহ্বান জানান তারা।

সভায় নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তী সরকারের অগ্রাধিকার কী হওয়া উচিত, তা নিয়ে প্রাথমিক কিছু প্রস্তাবনা তুলে ধরা হয়। একইসঙ্গে, সরকারকে কী ধরনের দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা লিখিত আকারে উপস্থাপন করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক গীতি আরা নাসরীন বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারকে প্রথমে তাদের উদ্দেশ্য স্পষ্ট করতে হবে। জুলাই মাসে হত্যাকাণ্ডের বিচার আন্তর্জাতিক আদালতে করতে হবে।’

প্রস্তাবে বিভিন্ন এলাকায় নতুন করে কমিউনিটি সেন্টার স্থাপনের প্রস্তাব করা হয়, যেখানে জুলাই হত্যাকাণ্ড এবং মুক্তিযুদ্ধের শহীদদের তালিকা, স্মৃতিস্তম্ভ এবং ছবি থাকবে। প্রতি বছর জুলাই মাসে সারাদেশে তাদের স্মরণে আয়োজনের ব্যবস্থা করার কথা বলা হয়।

এছাড়াও, রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় তরুণদের অংশগ্রহণের গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) অর্থনীতির সাবেক অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ সতর্ক করে বলেন, ‘বিপদ তিন দিক থেকে আসতে পারে: পূর্ববর্তী সরকারের সুবিধাভোগীরা, সামরিক ও বেসামরিক আমলাতন্ত্র এবং ভিন্ন ভিন্ন মতাদর্শ ও রাজনীতির যারা অন্যদের প্রতি অসহিষ্ণু।’

উল্লেখ্য, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক এর আগে শেখ হাসিনার পদত্যাগের আগে দেশের গণতান্ত্রিক রূপান্তরের জন্য একটি রূপরেখা উপস্থাপন করেছিল।

এই রূপরেখায় কীভাবে পদত্যাগ হবে, নতুন সরকার কীভাবে গঠিত হবে এবং তারা কী করবে তা বিস্তারিতভাবে বর্ণনা করা হয়েছিল।

নেটওয়ার্কের মতে, এই রূপরেখার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল সুনিশ্চিত করা যে স্বৈরাচারীর পতনের সময় বিরাট ত্যাগের বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত অন্তর্বর্তী সরকার যেন নতুন করে স্বৈরাচারী শাসনের পথ প্রশস্ত না করে।

রূপরেখাটি নিয়ে তুমুল বিতর্ক হয়, যা নেটওয়ার্ক ইতিবাচক হিসেবেই দেখে। এটি ইচ্ছাকৃতভাবে সংক্ষিপ্ত রাখা হয়েছিল, যাতে আলোচনা, বিতর্ক এবং মতবিনিময়ের মাধ্যমে এটি সম্প্রসারিত করা যায়। নেটওয়ার্কের পক্ষ থেকে বলা হয়, আজ থেকে আন্দোলনের বিভিন্ন অংশগ্রহণকারীদের নিয়ে সেই আলোচনা শুরু হলো।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক তানজিম উদ্দিন খান বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর সংরক্ষণের আহ্বান জানান।

লিখিত প্রস্তাবে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে যেসব দাবি তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো হলো:

• দীর্ঘমেয়াদে গণমাধ্যমকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। জনগণের মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে সাইবার নিরাপত্তা আইন বাতিল করতে হবে এবং এই আইনে আটক সকল নিরপরাধ ব্যক্তিকে মুক্তি দিতে হবে।
• পণ্য বাজারে সকল সিন্ডিকেট তাৎক্ষণিকভাবে বন্ধ করতে হবে এবং কৃষিখাতের বাজার ব্যবস্থাপনা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে হবে।
• জনবান্ধব প্রশাসন ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে আমলাতন্ত্রের সংস্কার করতে হবে এবং জুলাই হত্যাকাণ্ডের বিচারের জন্য যে ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হবে, তা নিরপেক্ষ হতে হবে। প্রশাসনকে দলীয় রাজনীতির প্রভাবমুক্ত রাখতে হবে।
• সকল দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক গোপন চুক্তি জনসম্মুখে প্রকাশ করতে হবে।
• দুর্নীতি দমন কমিশনের কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হবে যাতে দুর্নীতি দমনের কার্যক্রম শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তিকে দায়ী করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে। স্বৈরাচারী শাসনামলে সংঘটিত দুর্নীতি ও লুটপাটের বিচার করতে হবে।
• বাংলাদেশের বদলে যাওয়া বাস্তবতায় যোগ্য এবং বাস্তবায়নযোগ্য শিক্ষানীতি প্রণয়নের ভিত্তি তৈরির জন্য শিক্ষানীতি বিষয়ক নতুন টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে। বিদ্যমান পাঠ্যক্রম বাতিল, পুনর্গঠন এবং আধুনিকীকরণ নিয়ে আলোচনা করতে হবে।
• পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর ভূমি ফিরিয়ে দেওয়া এবং তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়াস চালাতে হবে এবং ভবিষ্যতে ভূমি দখল প্রতিরোধে একযোগে কাজ করতে হবে।
• প্রবাসীদের কেবল বিদেশী মুদ্রা অর্জনের উৎস হিসেবে না দেখে মানবিক দৃষ্টিতে দেখতে হবে এবং তাদের জীবন ও জীবনযাত্রার মানকে গুরুত্ব দিতে হবে।
• জরুরি ভিত্তিতে জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ক্ষেত্রে নিয়োজিত করতে হবে এবং জাতি, ধর্ম, লিঙ্গ ও শ্রেণি নির্বিশেষে সকলের জন্য নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে।
• জুলাই হত্যাকাণ্ড ও জনগণের উপর নৃশংস নির্যাতনের বিষয়টি তদন্ত করে দ্রুত বিচারের জন্য জাতিসংঘের সহযোগিতায় একটি তদন্ত কমিশন এবং বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করতে হবে।
• অর্থনীতি পুনরুজ্জীবিত করতে শিল্প কারখানা খুলে দিতে হবে এবং সকলের জন্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।