প্রথমবারের মতো ৪ কোটি টন ছাড়িয়ে গেল বাংলাদেশের চাল উৎপাদন

প্রথমবারের মতো, একটি অর্থবছরে (২০২৩-২৪) বাংলাদেশ ৪ কোটি টনেরও বেশি চাল উৎপাদন করেছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, প্রধানত চালের ফলন বৃদ্ধির ফলেই এই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। স্থানীয় কৃষকরা ধীরে ধীরে উচ্চফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের ধান চাষে ঝুঁকে পড়ছেন, যার ফলে দেশে চাল আমদানির প্রয়োজনীয়তা শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে।

চাল

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষকরা ৪.১০ কোটি টন চাল উৎপাদন করেছেন, যা আগের বছরের তুলনায় ৪.১ শতাংশ বেশি। গত ছয় বছরে এটিই সর্বোচ্চ প্রবৃদ্ধি।

আমন ধানের ফলন সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে, যা বোরো ধানের আগে গত শীতে কাটা হয়েছিল। বোরো বাংলাদেশের প্রধান ধান।

এই বছরের মে-জুন মাসে বোরো ধান কাটার পর কৃষকরা প্রায় ২.১০ কোটি টন চাল পেয়েছেন।

২০২৩-২৪ অর্থবছর টানা পঞ্চম বছরের জন্য চাল উৎপাদনে ধারাবাহিক বৃদ্ধির সাক্ষী। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান ওয়াইস কবির এই ঊর্ধ্বগতির জন্য ফলন বৃদ্ধিকে দায়ী করেছেন।

‘প্রধান কারণগুলির মধ্যে একটি হলো কৃষকরা আধুনিক জাতের ধান চাষে স্থানান্তরিত হয়েছেন। তারা আরও বেশি উচ্চফলনশীল এবং হাইব্রিড জাতের ধান চাষ করছেন। সময়ের সাথে সাথে আবাদি জমির পরিমাণও বেড়েছে,’ তিনি বলেন।

কৃষি অর্থনীতিবিদ জাহাঙ্গীর আলম বলেন, চাল উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে ধান আমদানি কমেছে।

‘আমাদের (২০২৩-২৪ অর্থবছরে) চাল আমদানি করতে হয়নি। তাছাড়া, এর দামের ওপর খুব বেশি প্রভাব পড়েনি, কারণ মনে হচ্ছে সরকারি ও বেসরকারি মজুদ পর্যাপ্ত ছিল,’ কবির আরও বলেন।

খাদ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১০.৫৬ লক্ষ টন চাল আমদানি করেছিল। অথচ চলতি বছরের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত কোনো সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানি করতে হয়নি।

কবির আরও বলেন, চাল আমদানি শূন্য হওয়ার অন্যতম কারণ ছিল গম আমদানি বৃদ্ধি।

তিনি বলেন, বেকারি ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পের পাশাপাশি পশুখাদ্য হিসেবেও গমের ব্যবহার বেড়েছে। এটি চালের চাহিদা হ্রাস করতে ভূমিকা রেখেছে।

চালের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক খাওয়া খাদ্যশস্য গমের আমদানি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৭১ শতাংশ বেড়ে ৬৬ লক্ষ টনে দাঁড়িয়েছে।

বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) একজন অধ্যাপক এম. আসাদুজ্জামান চাল উৎপাদনের হিসাব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। তিনি প্রশ্ন তোলেন, যদি সরবরাহ পর্যাপ্ত থাকে, তাহলে দাম কেন বেড়েছে?

‘উৎপাদন তেমনটা বাড়েনি যেমনটা রিপোর্ট করা হয়েছে। দাম বেশি হওয়ার অর্থ হলো সরবরাহের ঘাটতি রয়েছে,’ তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, খাদ্য মুদ্রাস্ফীতিতে চালের একটি বড় অংশ রয়েছে, যা গত অর্থবছরে বেশি ছিল।

বিবিএস জানিয়েছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে খাদ্য মুদ্রাস্ফীতি ৮.৭১ শতাংশ থেকে বেড়ে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১০.৬৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে।

সবচেয়ে সস্তা জাতের চালের দাম, গতকাল ঢাকায় প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে ৫০ টাকা থেকে ৫৫ টাকায়, যা গত বছরের তুলনায় ৭ শতাংশ বেশি।

আসাদুজ্জামান জানান, এ বছর বন্যা পরিস্থিতির কারণে আমন চাষ নিয়ে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে।

‘আমন উৎপাদন কম হলে আমাদের চাল আমদানি করতে হবে। আর তা আগামী নভেম্বরের শুরুতেই পরিষ্কার হয়ে যাবে। তাই আমদানি নিয়ে সরকারের আগামী মাসেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত,’ তিনি বলেন।

আগস্টের শেষের দিকে, মার্কিন কৃষি বিভাগ (ইউএসডিএ) জানিয়েছে যে, বিশেষ করে দেশের পূর্বাঞ্চলের ভয়াবহ বন্যার কারণে বাংলাদেশে আউশ এবং আমন ধানের আবাদি জমি এবং উৎপাদন কমতে পারে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, আমন ধানের আবাদি জমি আগের ৫৭.৩৫ লক্ষ হেক্টর থেকে কমে ৩৫.৫ লক্ষ হেক্টরে নেমে এসেছে।

কৃষি অর্থনীতিবিদ আলম বলেন, এ বছর আমন ধানের মোট উৎপাদন ১.৫৫ কোটি টন থেকে ১.৬০ কোটি টন হতে পারে।

‘বন্যার কারণে কৃষকদের দেরিতে চারা রোপণ করতে হয়েছে। এতে ফলন কম হতে পারে,’ তিনি বলেন।

তিনি আরও বলেন, খাদ্যশস্যের মজুদ পর্যাপ্ত থাকায় আমদানির প্রয়োজন হতে পারে না।

‘তবে পরবর্তী বোরো ধানের ফসল গুরুত্বপূর্ণ,’ তিনি বলেন।

‘কৃষকদের দোরগোড়ায় উৎপাদন উপকরণ, প্রধানত সারের জোগান নিশ্চিত করতে পারলে প্রধান খাদ্যশস্যের খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে আমাদের চিন্তা করতে হবে না।’

কবির বলেন, শেরপুর-নেত্রকোনা জেলায় চলমান বন্যার কারণে মাঠে থাকা আমন ধানের ফসলের ক্ষতি হবে এবং তা আর উদ্ধার করা সম্ভব হবে না।

‘তাই, আমাদের আমদানি করতে হবে কিনা তা নির্ভর করবে পরবর্তী আমন ধানের ফলনের ওপর। আর আসন্ন বোরোর ফলন নির্ভর করবে মূলত সরকারের সার ব্যবস্থাপনার ওপর।’

‘অন্তর্বর্তী সরকারকে বোরো ধানের ভালো ফলন নিশ্চিত করার জন্য সারের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে হবে,’ তিনি আরও বলেন।

ডেইলি স্টার অবলম্বনে