বাংলাদেশ-নির্ভরতা কমাতে বিশাল ব্যয়ে মিয়ানমারের ওপর নির্ভরশীল হচ্ছে ভারত!

বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক প্রভাব হ্রাস করে উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে মূল ভূখণ্ডের সংযোগ জোরদার করতে ভারত নতুন মহাসড়ক ও সমুদ্রপথ নির্মাণের দিকে ঝুঁকছে। এই পদক্ষেপে বাংলাদেশের ওপর নির্ভরশীলতা কমলেও মিয়ানমারের ওপর নতুন করে নির্ভরশীলতা তৈরি হচ্ছে, যা বাস্তবায়নে প্রয়োজন হবে বিশাল অঙ্কের বাজেট।

ভারতের প্রস্তাবিত রুটের নকশা

সম্প্রতি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরকালে করা একটি মন্তব্যকে কেন্দ্র করে ভারতের রাজনৈতিক মহলে সমালোচনার ঝড় ওঠে। ড. ইউনূস বলেছিলেন, ‘ভারতের উত্তরপূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো (সেভেন সিস্টার্স) স্থলবেষ্টিত এবং তাদেরকে সমুদ্র যোগাযোগের জন্য বাংলাদেশের ওপরেই নির্ভর করতে হয়’। ভারতের নতুন এই প্রকল্প যেন সেই বক্তব্যকেই মান্যতা দিচ্ছে, যেখানে তারা বাংলাদেশকে এড়িয়ে বিকল্প পথের সন্ধানে সক্রিয় হয়েছে।

ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে জানা গেছে, দেশটির ন্যাশনাল হাইওয়েজ অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন লিমিটেড (এনএইচআইডিসিএল) মেঘালয়ের শিলং থেকে আসামের শিলচর পর্যন্ত প্রায় ১৬৭ কিলোমিটার দীর্ঘ একটি চার লেনের জাতীয় মহাসড়ক নির্মাণের প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে। এর মধ্যে ১৪৫ কিলোমিটার মেঘালয়ে এবং ২২ কিলোমিটার আসামে পড়বে। প্রায় ২২ হাজার ৮৬৪ কোটি রুপি ব্যয়ে নির্মিতব্য এই প্রকল্পটি ২০৩০ সালের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে। গত ৩০ এপ্রিল ভারতের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা এই প্রকল্পের অনুমোদন দিয়েছে। এর মাধ্যমে ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর ও আসামের বারাক উপত্যকা মূল ভারতের সঙ্গে আরও নিবিড়ভাবে যুক্ত হবে। মিয়ানমারের সঙ্গেও এ বিষয়ে আলোচনা চূড়ান্ত হয়েছে বলে খবরে উল্লেখ করা হয়েছে।

এই মহাসড়কের পাশাপাশি কলকাতা থেকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সিত্তে বন্দর হয়ে পালেতওয়া নদীপথ এবং পরে মিজোরামের জোরিনপুই পর্যন্ত একটি বিকল্প মাল্টিমোডাল করিডোরও নির্মাণ করছে ভারত। ‘কালাদান মাল্টিমোডাল ট্রানজিট ট্রান্সপোর্ট প্রকল্প’ নামে পরিচিত এই সংযোগ ব্যবস্থায় কলকাতা থেকে বঙ্গোপসাগর পেরিয়ে সিত্তে বন্দর, সেখান থেকে নদীপথে পালেতওয়া এবং সবশেষে সড়কপথে মিজোরাম হয়ে সমগ্র উত্তর-পূর্বাঞ্চলে যোগাযোগ স্থাপিত হবে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এনএইচআইডিসিএলের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘বাংলাদেশের ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে কলকাতা ও ভিজাগ বন্দর থেকে উত্তরপূর্বাঞ্চলে পণ্য পাঠাতে আমাদের নতুন পথ খুঁজতে হচ্ছে। এই মহাসড়ক ও কালাদান করিডোর সেই বিকল্প হিসেবে কাজ করবে এবং সংশ্লিষ্ট অঞ্চলে অর্থনৈতিক কার্যক্রম বৃদ্ধি পাবে।’

তবে এই প্রকল্প ঘিরে উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ রয়েছে। রাখাইন রাজ্যের বেশিরভাগ এলাকাই বর্তমানে মিয়ানমারের সামরিক জান্তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে এবং সেখানে আরাকান আর্মিসহ বিভিন্ন বিদ্রোহী গোষ্ঠীর তৎপরতা লক্ষণীয়। ফলে, বাংলাদেশের ওপর থেকে নির্ভরতা কমাতে গিয়ে ভারতকে এক অনিশ্চিত ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, শেখ হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশের সঙ্গে ট্রানজিট রুট নিয়ে আলোচনার কিছুটা অগ্রগতি হলেও, ৫ আগস্ট তার সরকারের পতনের পর রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর ভারতের সঙ্গে ট্রানজিট ইস্যুতে আলোচনা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে, বাংলাদেশকে এড়িয়ে ভারতের নতুন কৌশল বাস্তবায়নে মিয়ানমারের ওপর যে একটি নতুন নির্ভরতা তৈরি হচ্ছে, তা অনস্বীকার্য।

ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি, এই প্রকল্প শুধু পণ্য পরিবহনের জন্যই নয়, কৌশলগত দিক থেকেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এর মাধ্যমে চীনের প্রভাব মোকাবিলায় উত্তরপূর্বাঞ্চলে ভারতের সামরিক উপস্থিতি আরও শক্তিশালী করা যাবে। পাশাপাশি, শিলং-শিলচর মহাসড়ক চালু হলে যাত্রাপথের সময় সাড়ে আট ঘণ্টা থেকে কমে পাঁচ ঘণ্টায় নেমে আসবে, যা বাণিজ্যিক যোগাযোগে নতুন গতি সঞ্চার করবে।

সূত্র: ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস