বিডিবিএল ভবনের ‘মৃত্যুকূপ’ লিফট: সাংবাদিক ও ভুক্তভোগীদের আতঙ্ক ও ক্ষোভ

রাজধানীর ব্যস্ততম বাণিজ্যিক এলাকা কারওয়ান বাজারে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (বিডিবিএল) ভবনে মঙ্গলবার (২৭ মে) সকালে এক ভয়াবহ লিফট দুর্ঘটনা ঘটেছে। এই ঘটনায় অন্তত ৯ জন আহত হয়েছেন এবং ভবনে কর্মরত সাংবাদিক ও ভুক্তভোগীদের মধ্যে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে।

বিডিবিএল ভবন

মঙ্গলবার সকাল আনুমানিক সাড়ে আটটার দিকে ১৮ তলা বিশিষ্ট বিডিবিএল ভবনের একটি লিফট যান্ত্রিক ত্রুটির কবলে পড়ে আকস্মিকভাবে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। তেজগাঁও থানার পরিদর্শক (তদন্ত) নাজমুল জান্নাত শাহ্ ঘটনাটি নিশ্চিত করে জানান, লিফটটি প্রথমে দ্বিতীয় তলা থেকে নিচে নিচতলার ফ্লোরে ধাক্কা খায় এবং এরপর অস্বাভাবিক গতিতে প্রায় ১৫ তলা পর্যন্ত উপরে উঠে যায়।

দুর্ঘটনার পরপরই আহত পাঁচজনকে উদ্ধার করে রাজধানীর পান্থপথ এলাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, আহতদের আঘাত গুরুতর না হলেও তাদের পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।

উল্লেখ্য, কারওয়ান বাজারের এই গুরুত্বপূর্ণ বিডিবিএল ভবনটিতে বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের নিজস্ব কার্যক্রম ছাড়াও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যালয় রয়েছে। দেশের স্বনামধন্য গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠান দৈনিক বণিক বার্তা এবং একাত্তর টেলিভিশনের কার্যালয়ও এই ভবনেই অবস্থিত। এই দুর্ঘটনার ফলে ভবনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে বিঘ্ন ঘটে। সেখানে কর্মরত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কর্মীদের দিনভর পায়ে হেঁটে ওঠানামা করতে হয়েছে। শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এখনও লিফট চালু হয়নি। কবে চালু হবে এ বিষয়েও কোনো পরিষ্কার নির্দেশনা দেয়নি বিডিবিএল কর্তৃপক্ষ।

দীর্ঘদিনের শঙ্কা ও সাংবাদিকদের অভিজ্ঞতা

এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা ভবনে কর্মরতদের মধ্যে, বিশেষ করে বণিক বার্তায় কর্মরত সাংবাদিকদের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। দুর্ঘটনার পরপরই একাধিক সাংবাদিক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে তাদের দীর্ঘদিনের শঙ্কা ও তিক্ত অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন। তাদের স্ট্যাটাসে কর্তৃপক্ষের চরম উদাসীনতা ও লিফটের বেহাল দশার চিত্র ফুটে উঠেছে।

বণিক বার্তার সাংবাদিক আনিকা মাহজাবিন তার ফেসবুক স্ট্যাটাসে লিখেছেন যে, এই ভবনের লিফটে দুর্ঘটনা এবারই প্রথম নয়, এর আগে একজনের মৃত্যুর ঘটনাও ঘটেছে। তিনি কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতির সমালোচনা করে বলেছেন, বিডিবিএলের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এই লিফট ব্যবহার করলেও তারা যেন না মরেন, তা ভবন কর্তৃপক্ষ শতভাগ নিশ্চিত করে। এজন্য তাদের আগমনের আগের দিন লিফটগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয় এবং ভিআইপিরা লিফটে আরোহন করলে অন্য কাউকে উঠতে দেওয়া হয় না।

তিনি সাধারণ দিনের লিফটের ভয়াবহ অবস্থার বর্ণনা দিয়ে জানান, আঠারো তলায় উঠতেই লিফট ঝাঁকুনি দিয়ে শুরু করে, কখনো কখনো কাঁপতে থাকে। এমনকি লিফট সাত তলায় যাওয়ার কথা থাকলেও সাড়ে ছয় তলায় আটকে গিয়ে কর্তৃপক্ষ দরজা বলপ্রয়োগ করে খুলে দেয়, তখন লাফ দিয়ে নামতে হয়। আজকের দুর্ঘটনা থেকে তিনি কয়েক মিনিটের জন্য রক্ষা পেয়েছেন বলে উল্লেখ করেন এবং এই গাফিলতি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

আরেক সাংবাদিক মৌটুসী জুবাইদা রহমান লিখেছেন, বিডিবিএল ভবনের লিফট তার আজীবনের জন্য ট্রমা তৈরি করে দিয়েছে। তিনি জানান, ১৮ তলা ভবনের চারটি লিফটের মধ্যে একটি সারা বছরই খারাপ থাকে। প্রতিদিন এত মানুষ ব্যবহার করলেও কর্তৃপক্ষের কোনো হুঁশ নেই। লিফটে উঠতে গেলেই ঝাঁকি খাওয়া, যেকোনো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং ২/৩ ফ্লোর নিচে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা প্রায়শই ঘটে। তিনি নিজে দুই দুইবার এমন পরিস্থিতিতে পড়েছেন এবং একা ছিলেন বলে উল্লেখ করেন।

তিনি কর্তৃপক্ষের ভিআইপিদের জন্য বিশেষ নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়েও ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, তাদের জন্য ১৬ আনা সেফটি নিশ্চিত করা হলেও সাধারণ ছাপোষা মানুষ লিফটে এক্সিডেন্ট করে মরলে তাদের কিছু যায় আসে না। ভিআইপিরা আসলে নাকি আগের দিন লিফট চেকিং হয়।

সাংবাদিক শফিকুল ইসলাম তার স্ট্যাটাসে লিখেছেন, তিনি এই লিফটে চারবার সমস্যায় পড়েছেন। অন্তত তিন ফ্লোর নিচে স্লিপ করে গিয়ে আটকে থাকার অভিজ্ঞতা হয়েছে তার। তিনি জানান, এই ঘটনা বারবার ঘটছে এবং এর আগেও মানুষ মারা গেছে। প্রায় প্রতিদিন লিফটের সার্ভিসিং চললেও তিনি প্রশ্ন তুলেছেন, একটি মরা জিনিস আর কতদিন সার্ভিসিং করে চলবে। অফিসে ওঠার সময় লিফটে পা দিলেই তার পা শিরশির করে কখন বড় দুর্ঘটনা ঘটবে, এই শঙ্কা তার ছিল। আজকের ঘটনা সেই শঙ্কাকেই সত্যি করেছে এবং চারবারের ট্রমা এখনও কাটেনি বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সাংবাদিকদের এই স্ট্যাটাসগুলো বিডিবিএল ভবনের লিফটগুলোর বেহাল দশা এবং ভবন কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার চিত্র তুলে ধরেছে। আজকের দুর্ঘটনা দীর্ঘদিনের জমে থাকা শঙ্কাকেই সত্যি করেছে এবং ভবনে কর্মরতদের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে প্রশ্ন তৈরি করেছে।