সংঘাত তীব্রতর: ইরানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ চাইলেন ট্রাম্প, জবাবে খামেনির কঠোর হুঁশিয়ারি

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পক্ষ থেকে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের আহ্বান সত্ত্বেও ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘাত ষষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে। বুধবার দুই দেশই একে অপরের দিকে নতুন করে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে, যা মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনাকে আরও তীব্র করে তুলেছে।

আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি ও ডোনাল্ড ট্রাম্প

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানিয়েছে, বুধবার ভোরের প্রথম দুই ঘণ্টায় ইরানের পক্ষ থেকে দুই দফায় ইসরায়েলের দিকে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়। এর পরপরই তেল আবিবের আকাশে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। অন্যদিকে, ইসরায়েল তেহরানের পার্শ্ববর্তী এলাকার বাসিন্দাদের সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে, যাতে তারা ইরানের সামরিক স্থাপনায় হামলা চালাতে পারে। ইরানের সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে, রাজধানী তেহরান এবং এর পশ্চিমে কারাজ শহরেও বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে।

এই পরিস্থিতিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মন্তব্য নতুন করে আলোচনার জন্ম দিয়েছে। মঙ্গলবার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ধৈর্য ফুরিয়ে আসছে।’ ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনিকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘তথাকথিত ‘সর্বোচ্চ নেতা’ কোথায় লুকিয়ে আছেন, তা আমরা জানি। আমরা এখনই তাকে সরাতে যাচ্ছি না... তবে আমাদের ধৈর্য কমে আসছে।’ এর মাত্র তিন মিনিট পরেই তিনি পোস্ট করেন, ‘নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ!’

হোয়াইট হাউসের একজন কর্মকর্তা নিশ্চিত করেছেন, ট্রাম্প মঙ্গলবার ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনে কথা বলেছেন। তবে এই সংকটে ট্রাম্পের পরস্পরবিরোধী বার্তা অনিশ্চয়তা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে। তিনি একদিকে যেমন সামরিক হুমকি দিচ্ছেন, তেমনই কূটনৈতিক সমাধানের কথাও বলছেন।

ইরান-ইসরায়েলের কঠোর অবস্থান

ট্রাম্পের হুমকির কয়েক ঘণ্টা পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্সে পাল্টা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘সন্ত্রাসী জায়নবাদী শাসকদের বিরুদ্ধে আমাদের কঠোর জবাব দিতে হবে। আমরা জায়নবাদীদের কোনো রকম করুণা দেখাব না।’

গত সপ্তাহে ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনার পাশাপাশি আবাসিক এলাকাতেও নজিরবিহীন বিমান হামলা শুরু করে। তাদের দাবি, ইরান পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে গেছে। এর জবাবে ইরানও ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালাচ্ছে। বুধবার সকালে তারা ইসরায়েলে হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের দাবি করেছে।

সাইবার যুদ্ধ ও অভ্যন্তরীণ চাপ

সামরিক সংঘাতের পাশাপাশি ইরান ও ইসরায়েল এক ভয়াবহ সাইবার যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। ইরানের গণমাধ্যম জানিয়েছে, ইসরায়েল তাদের ডিজিটাল অবকাঠামোতে ‘ব্যাপক সাইবার যুদ্ধ’ শুরু করেছে। এই পরিস্থিতিতে ইরানের বিপ্লবী গার্ড বাহিনী দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করার অভিযোগে ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের পাঁচজন সন্দেহভাজন এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছে। দেশটির সাইবারসিকিউরিটি কমান্ড কর্মকর্তাদের সব ধরনের ব্যক্তিগত যোগাযোগ ডিভাইস ও মোবাইল ফোন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলি হামলায় খামেনির প্রধান সামরিক ও নিরাপত্তা উপদেষ্টাদের অনেকেই নিহত হয়েছেন, যা তার ঘনিষ্ঠ বৃত্তকে দুর্বল করে দিয়েছে।

আঞ্চলিক প্রভাব ও ক্ষয়ক্ষতি

এই সংঘাতের ফলে ইরানের আঞ্চলিক প্রভাবও হ্রাস পাচ্ছে। গাজায় হামাস, লেবাননে হিজবুল্লাহ এবং ইয়েমেনে হুথিদের মতো ইরানের মিত্র গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলি হামলায় দুর্বল হয়ে পড়েছে। ইরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদও ক্ষমতাচ্যুত হয়েছেন।

ইরানি কর্মকর্তাদের মতে, এই সংঘাতে এখন পর্যন্ত ২২৪ জন নিহত হয়েছে, যাদের অধিকাংশই বেসামরিক নাগরিক। অন্যদিকে, ইসরায়েল জানিয়েছে তাদের ২৪ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হয়েছে।

জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইএইএ জানিয়েছে, ইসরায়েলি হামলায় ইরানের নাতানজ পারমাণবিক কেন্দ্রের ভূগর্ভস্থ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্রে সরাসরি আঘাত হেনেছে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বজুড়ে জ্বালানি তেলের বাজারেও চরম সতর্কতা জারি করা হয়েছে।