শীতল যুদ্ধের ছায়া ফিরছে: রাশিয়া সীমান্তে ফিনল্যান্ডের ব্যাপক সামরিক প্রস্তুতি

রাশিয়ার সীমান্ত থেকে মাত্র ১০ মাইল দূরে একটি সামরিক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে নিজের গাড়ি থেকে একটি ছোট নজরদারি ড্রোন ও তার নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বের করছিলেন ফিনল্যান্ডের সংরক্ষিত সেনা সদস্য জ্যান লাট্টো। তার মতে, প্রতিবেশী রাশিয়ার সঙ্গে ভবিষ্যতের যেকোনো সংঘাত মোকাবিলায় এই সরঞ্জাম অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

ম্যাপে রাশিয়া ও ফিনল্যান্ডের অবস্থান

দুই বছর আগে ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের পর ফিনল্যান্ড পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোতে যোগ দেয়। এর পর থেকেই দুই দেশের মধ্যে ১,৩৪০ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্তে পুনরায় শীতল যুদ্ধের সময়ের উত্তেজনা ফিরে এসেছে। রাশিয়া ও ইউরোপের মধ্যে এটি দীর্ঘতম সীমান্ত। ফিনল্যান্ড তার বিশাল সংরক্ষিত সামরিক বাহিনীকে আরও শক্তিশালী করার পাশাপাশি নিজেদের দেশে ন্যাটোর একটি নতুন সামরিক কমান্ড স্থাপন করতে চলেছে।

এক সময়ের ব্যস্ত সীমান্ত অঞ্চল এখন থমথমে। কাঁটাতার দেওয়া উঁচু বেড়া তৈরি করা হয়েছে, যা দুই দেশকে বিচ্ছিন্ন করেছে। অভিবাসনকে রাশিয়া অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে—এমন অভিযোগ তুলে ফিনল্যান্ড সীমান্ত বন্ধ করে দেওয়ার পর রুশ পর্যটকদের পদচারণায় মুখর থাকা বিপণিবিতান ও রেস্তোরাঁগুলো এখন জনশূন্য। অন্যদিকে, উপগ্রহ চিত্রে দেখা যাচ্ছে, রাশিয়াও ধীরে ধীরে সোভিয়েত আমলের পুরোনো সামরিক ঘাঁটিগুলোকে পুনরায় সক্রিয় করছে।

ফিনল্যান্ডের সীমান্ত অঞ্চলের এক ডজনেরও বেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই বিভাজনের ফলে অনেকে তাদের আত্মীয়-স্বজনের সঙ্গে দেখা করতে পারছেন না এবং স্থানীয় অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতির মুখে পড়েছে। তবে অনেকেই মনে করেন, ভবিষ্যতের সম্ভাব্য সংঘাত প্রতিরোধ ও তার জন্য প্রস্তুতি নিতে এই পদক্ষেপগুলো জরুরি।

ল্যাপেনরান্টা শহরের কাছে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ৪৭ বছর বয়সী জ্যান লাট্টো জানান, ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসন রাশিয়া সম্পর্কে তার ধারণাকে পুরোপুরি বদলে দিয়েছে। তিনি বলেন, ‘ওরা যদি ইউক্রেনের মতো আমাদের সীমান্তও পরিবর্তন করতে আসে, তখন কী হবে?’ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়নের ফিনল্যান্ড আক্রমণের স্মৃতিচারণ করে তিনি বলেন, সেই যুদ্ধে ফিনল্যান্ড তার ভূখণ্ডের প্রায় ১০ শতাংশ হারাতে বাধ্য হয়েছিল।

অবশ্য দুই দেশই একে অপরের জন্য হুমকি নয় বলে দাবি করে আসছে। ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতি আলেকজান্ডার স্টাব বলেছেন, ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যোগদানের প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার সামরিক উপস্থিতি বাড়ানো একটি স্বাভাবিক ঘটনা। তবে গত বছর ফিনল্যান্ডের প্রতিরক্ষা প্রতিবেদনে সশস্ত্র সংঘাতের ঝুঁকি বাড়ার কথা বলা হয়েছিল।

এই পরিস্থিতিতে ফিনল্যান্ড ভূমি-মাইন মজুদ করার পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে। ফিনিশ-রুশ দ্বৈত নাগরিকদের ড্রোন উড়ানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং রুশদের সম্পত্তি কেনায় সীমাবদ্ধতা আনা হয়েছে। ফিনল্যান্ডের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিনা ভালতোনেন বলেন, ‘ন্যাটো দেশগুলোর সঙ্গে রাশিয়ার মোট স্থল সীমান্তের অর্ধেকেরও বেশির দায়িত্ব ফিনল্যান্ডের ওপর। আমাদের লক্ষ্য এই সীমান্তকে অলঙ্ঘনীয় রাখা।’

এই উত্তেজনার মধ্যেও ফিনল্যান্ডের সংরক্ষিত সেনারা স্বেচ্ছায় সামরিক প্রশিক্ষণে অংশ নিচ্ছেন। ইউক্রেন যুদ্ধের পর এই ধরনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা প্রায় এক-তৃতীয়াংশ বেড়েছে। সংরক্ষিত সেনার সংখ্যা ২০৩১ সালের মধ্যে ১০ লক্ষে উন্নীত করার পরিকল্পনা রয়েছে।

বিচ্ছিন্ন পরিবার ও অর্থনৈতিক ক্ষতি

সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্তে স্থানীয় ব্যবসা-বাণিজ্য মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। একসময় যেখানে বছরে প্রায় ১ কোটি ৩০ লক্ষ মানুষ সীমান্ত পারাপার করত, তা এখন বন্ধ। এতে স্থানীয় অর্থনীতি থেকে বছরে কমপক্ষে ৩০০ মিলিয়ন ইউরো উধাও হয়ে গেছে এবং বেকারত্বের হার জাতীয় গড়ের চেয়ে বেড়ে প্রায় ১৫ শতাংশে পৌঁছেছে।

অক্সানা সেরেব্রিয়াকোভা নামে এক নারী মহামারির পর মস্কো থেকে ফিনল্যান্ডে চলে আসেন। কিন্তু সীমান্ত বন্ধ হওয়ায় রাশিয়ায় থাকা তার স্বামী ও বড় ছেলের সঙ্গে পরিবারটি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। তিনি বলেন, ‘এটি একটি অত্যন্ত দুঃখজনক পরিস্থিতি।’

পুনরায় সীমান্ত সুরক্ষিত করার যুগ

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কয়েক দশক ধরে ফিনল্যান্ড ধীরে ধীরে রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য ও ভ্রমণের সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছিল। কিন্তু এখন হেলসিঙ্কি ও সেন্ট পিটার্সবার্গের সংযোগকারী প্রধান সড়কটি সীমান্তে এসে ধাতব প্রতিবন্ধকতায় শেষ হয়েছে। ফিনল্যান্ড তার সীমান্তের সবচেয়ে দুর্বল অংশগুলোতে ২০০ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৪.৫ মিটার উঁচু বেড়া তৈরি করছে, যেখানে ক্যামেরা এবং গতি শনাক্তকারী যন্ত্র বসানো হয়েছে।

ফিনল্যান্ডের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর অপারেশন প্রধান স্যামুয়েল সিলজানেন বলেন, ‘আমরা সীমান্ত শিথিল করার যুগ থেকে পুনরায় সীমান্ত সুরক্ষিত করার যুগে প্রবেশ করেছি।’

হেলসিঙ্কি বিশ্বাস করে, ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ হলে রাশিয়া তার প্রতিবেশী অঞ্চলে সামরিক শক্তি আরও বাড়াবে। যদিও এখন পর্যন্ত বড় কোনো হুমকি দেখা যাচ্ছে না, তবে ফিনল্যান্ড তার সামরিক সক্ষমতা ক্রমাগত বৃদ্ধি করে চলেছে। দেশটি ৬৪টি মার্কিন এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান কেনার চুক্তি করেছে এবং পশ্চিম ইউরোপের মধ্যে তাদের কাছেই সবচেয়ে বড় গোলন্দাজ বাহিনীর সম্ভার রয়েছে। ফিনল্যান্ডের পূর্বে অবস্থিত মিক্কেল্লি শহরে ন্যাটোর নতুন উত্তর কমান্ড স্থাপন করা হবে, যা সীমান্ত থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার দূরত্বে অবস্থিত। এর মাধ্যমে ফিনল্যান্ড স্পষ্ট বার্তা দিতে চায় যে, যেকোনো আগ্রাসনের চেষ্টা লাভজনক হবে না।