সোহাগ হত্যাকাণ্ড: অভিযুক্তদের শাস্তির দাবিতে উত্তাল শিক্ষাঙ্গন

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগ নামে এক ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে হত্যার প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে উঠেছে দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), জাহাঙ্গীরনগর ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে একযোগে বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। এ ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তি দাবি করেছেন তারা।

পুরান ঢাকার মিটফোর্ড এলাকায় ভাঙারি ব্যবসা নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট দ্বন্দ্বে গত বৃহস্পতিবার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে লাল চাঁদ ওরফে সোহাগকে পাথর দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয় বলে অভিযোগ উঠেছে। কেরানীগঞ্জের বাসিন্দা সোহাগ মিটফোর্ড এলাকায় ব্যবহৃত তামা ও অ্যালুমিনিয়ামের তারের ব্যবসা করতেন।

শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন পৃথক বিক্ষোভ মিছিল বের করে। বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশন, ইসলামী ছাত্র আন্দোলন বাংলাদেশসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা আবাসিক হল এলাকা এবং রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশ থেকে বিক্ষোভ শুরু করেন।

সমাবেশে বক্তারা অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলার জন্য বিএনপি ও এর অঙ্গসংগঠনগুলোর সমালোচনা করেন। তারা সোহাগসহ সারা দেশে ঘটা সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার দাবি করেন।

বাংলাদেশ ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি সৈকত আরিফ অভিযোগ করে বলেন, ‘হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে আমরা দেখছি বিএনপির নেতা-কর্মীরা স্থানীয় বাজার, ব্যবসা এবং অন্যান্য বিষয় নিয়ন্ত্রণের জন্য নিজেদের মধ্যে সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে। এর অনেকগুলোই হত্যাকাণ্ডে গড়িয়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিএনপি মনে করে, দল থেকে বহিষ্কার করেই দায় সারতে পারবে। কিন্তু আমরা বিএনপিকে বলতে চাই, শুধু বহিষ্কারই যথেষ্ট নয়। যাদের বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিচ্ছেন, তাদের বিচার নিশ্চিত করুন। এটি নিশ্চিত করতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে চাপ দিন। জুলাই অভ্যুত্থানের পর যদি কেউ দেশকে পুরোনো ধারায় ফিরিয়ে নেওয়ার কথা ভাবে, তবে তারা ভুল করবে। বাংলাদেশ আর পেছনের দিকে যাবে না।’

বাংলাদেশ ছাত্র অধিকার পরিষদের সভাপতি বিন ইয়ামিন মোল্লা বলেন, ‘ছাত্ররা আজ সোহাগ হত্যার প্রতিবাদ করছে, যেমনটা তারা আওয়ামী লীগের সময়েও করেছিল। বিএনপি নিজেদের নেতা-কর্মীদের নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। আমরা এই চাঁদাবাজ অপরাধীদের বিচার চাই। আমরা সকল হত্যাকাণ্ডের বিচার চাই।’

শুক্রবার রাতেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতা-কর্মীরাও অভিযুক্তদের দ্রুত বিচারের দাবিতে একটি মিছিল বের করেন। রাত ১০টার দিকে টিএসসি এলাকা থেকে মিছিলটি শুরু হয়ে উপাচার্যের বাসভবনের পাশের সড়কে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হয়। সমাবেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় সাহস বলেন, ‘গত ৯ জুলাই মিটফোর্ড হাসপাতালের সামনে যেভাবে সোহাগকে হত্যা করা হয়েছে এবং হত্যাকারীরা উল্লাস করেছে, আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। আমরা অবিলম্বে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি। দ্রুত বিচার নিশ্চিত না হলে ছাত্রদল কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করবে।’

একই হত্যাকাণ্ডের বিচার চেয়ে গতরাতে রাজু ভাস্কর্যের পাদদেশে বিক্ষোভ করেন বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। রাত ১১টার দিকে একটি মিছিল বের করার পর তারা ভাস্কর্যের সামনে সমবেত হন এবং একটি লিখিত বিবৃতির মাধ্যমে পাঁচ দফা দাবি ঘোষণা করেন। তাদের দাবির মধ্যে রয়েছে—হত্যাকাণ্ডের দ্রুত ও নিরপেক্ষ বিচার, অবিলম্বে সকল অভিযুক্তকে গ্রেপ্তার এবং দায়ী ব্যক্তিদের সর্বোচ্চ শাস্তি প্রদান। এ ছাড়া সারা দেশে চাঁদাবাজি ও নিয়োগ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা এবং অপরাধীদের বাঁচাতে রাজনৈতিক পরিচয়ের অপব্যবহার বন্ধ করার জন্য কর্তৃপক্ষের প্রতি আহ্বান জানান তারা।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও এই হত্যাকাণ্ডে যুবদলের সদস্যদের জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে নিন্দা জানিয়েছেন শিক্ষার্থীরা। রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে বিক্ষোভ শুরু হয়। বিক্ষোভকারীরা মুক্তমঞ্চ এলাকা প্রদক্ষিণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক পার হয়ে মিটফোর্ড মোড় অবরোধ করে বিচারের দাবি জানান।

ইসলামী ছাত্রশিবিরের জবি শাখার সাধারণ সম্পাদক আব্দুল আলিম আরিফ বলেন, ‘দুই দিন ধরে এই হত্যাকাণ্ডের দৃশ্য কীভাবে চাপা ছিল, তা নিয়ে আমরা প্রশ্ন তুলছি। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে এই নৃশংসতার হোতাদের অবিলম্বে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাচ্ছি।’

বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের কেন্দ্রীয় যুগ্ম আহ্বায়ক নূর নবী বলেন, ‘এই পাথর শুধু আমার ভাইয়ের ওপর ছোড়া হয়নি, এটি প্রতিটি নাগরিকের হৃদয়ে আঘাত করেছে। ফ্যাসিবাদী আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে এমন নৃশংসতা চালিয়েছে, আর এখন বিএনপি ও যুবদল সেই পথই অনুসরণ করছে। আমাদের অবস্থান স্পষ্ট, আমরা এই অরাজকতা চলতে দেবো না।’

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীরা গতরাতে এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিক্ষোভ করেছেন। রাত ১০টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলা এলাকা থেকে মিছিল বের হয়ে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন অংশ প্রদক্ষিণ করে।

এদিকে, বরিশালেও ‘সাধারণ ছাত্রছাত্রী’দের ব্যানারে শিক্ষার্থীরা বিক্ষোভ করেছেন। রাত পৌনে ১১টার দিকে বিভিন্ন কলেজের শিক্ষার্থীদের একটি বিক্ষোভ মিছিল নাথুল্লাবাদ থেকে শুরু হয়ে সদর রোডের অশ্বিনী কুমার হলের সামনে গিয়ে শেষ হয়। বিক্ষোভকারী সাব্বি হোসেন সোহাগ অভিযোগ করেন, একটি নির্দিষ্ট দল সারা দেশে চাঁদাবাজি চালাচ্ছে এবং দিনের বেলায় ব্যবসায়ীদের হত্যা করছে।

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা মিটফোর্ডের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং দেশব্যাপী চলমান চাঁদাবাজি ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে সমাবেশ করেছেন। শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের জোহা চত্বরে এই সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সাবেক সমন্বয়ক মেহেদী সজীব বলেন, ‘জুলাই অভ্যুত্থানের পর এক বছরে আমরা সন্ত্রাস, দখলদারি ও হত্যাকাণ্ডের ধারাবাহিকতা দেখেছি। এর সবগুলোর পেছনে বিএনপি ও তার অঙ্গসংগঠনগুলোর সক্রিয় সম্পৃক্ততা রয়েছে।’

আরেক সাবেক সমন্বয়ক সালাউদ্দিন আম্মার বলেন, ‘প্রশাসনের পাশাপাশি গণমাধ্যমেরও সংস্কার প্রয়োজন। একটি হত্যাকাণ্ড গণমাধ্যমে আসতে ৪৮ ঘণ্টার বেশি সময় লেগে যাওয়াটা উদ্বেগজনক। গণমাধ্যম যদি সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করত, তাহলে বিচারপ্রক্রিয়া আরও আগেই শুরু হতে পারত।’