ফ্রান্সের অধীনেই রাষ্ট্র হচ্ছে নিউ ক্যালেডোনিয়া

ফ্রান্স ও নিউ ক্যালেডোনিয়ার মধ্যে একটি ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের বিতর্কিত এই ভূখণ্ডটি ‘নিউ ক্যালেডোনিয়া রাষ্ট্র’ হিসেবে পরিচিতি পাবে। তবে পূর্ণ স্বাধীনতা না পেয়ে এটি ফরাসি প্রজাতন্ত্রের অধীনে একটি স্বশাসিত রাষ্ট্র হিসেবেই থাকছে।

শনিবার (১২ জুলাই) প্যারিসে ফরাসি সরকার এবং নিউ ক্যালেডোনিয়ার স্বাধীনতাপন্থী ও ইউনিয়নপন্থী দলগুলোর মধ্যে দীর্ঘ আলোচনার পর ১৩ পৃষ্ঠার এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। গত বছর বিতর্কিত নির্বাচনী সংস্কারকে কেন্দ্র করে অঞ্চলটিতে ব্যাপক সহিংসতার পর এই গুরুত্বপূর্ণ সমঝোতা হলো। চুক্তিতে নিউ ক্যালেডোনিয়াকে নিজস্ব জাতীয়তাসহ একটি রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল মাক্রোঁ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে বলেন, “প্রজাতন্ত্রের ভেতরে নিউ ক্যালেডোনিয়া রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা আস্থার ওপর নেওয়া একটি বড় পদক্ষেপ। এখন পারস্পরিক শ্রদ্ধা, স্থিতিশীলতা ও সদিচ্ছার ভিত্তিতে একসঙ্গে ভবিষ্যৎ গড়ার সময় এসেছে।”

চুক্তি অনুযায়ী, নিউ ক্যালেডোনিয়া নিজস্ব বৈদেশিক নীতি নিজেরাই নিয়ন্ত্রণ করবে। তবে প্রতিরক্ষা, মুদ্রা, নিরাপত্তা ও বিচার বিভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ সার্বভৌম ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি ভবিষ্যৎ গণভোটের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে। ফরাসি পত্রিকা লা মন্ডে জানিয়েছে, এর মাধ্যমে ভবিষ্যতে জাতিসংঘের পূর্ণ সদস্য হওয়ার পথও সুগম হতে পারে।

চলতি বছরের চতুর্থ প্রান্তিকে ফ্রান্সের পার্লামেন্টের উভয় কক্ষে চুক্তিটি অনুমোদনের জন্য ভোটাভুটি হবে। এরপর ২০২৬ সালে নিউ ক্যালেডোনিয়ার জনগণের মতামত জানতে একটি গণভোট অনুষ্ঠিত হবে।

উল্লেখ্য, ২০২৪ সালের মে মাসে প্যারিস সরকার সেখানকার নির্বাচনে দীর্ঘদিনের অ-আদিবাসী বাসিন্দাদের ভোটাধিকার দেওয়ার জন্য একটি আইন প্রস্তাব করলে অঞ্চলটিতে ব্যাপক সংঘাত ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রস্তাবটি ১৯৯৮ সালের একটি চুক্তিকে দুর্বল করে দিত, যেখানে এ ধরনের অধিকার সীমিত রাখা হয়েছিল।

নিউ ক্যালেডোনিয়ার প্রায় তিন লাখ জনসংখ্যার ৪০ শতাংশই কানাক আদিবাসী। তাদের আশঙ্কা ছিল, এই আইন কার্যকর হলে তারা নিজ ভূখণ্ডে স্থায়ীভাবে সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে এবং স্বাধীনতার স্বপ্ন চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে।

এই প্রস্তাবকে ঘিরে ছড়িয়ে পড়া সহিংসতায় ১৪ জন নিহত হন এবং অঞ্চলটির অর্থনীতিতে প্রায় দুই বিলিয়ন ইউরো (প্রায় দুই দশমিক তিন বিলিয়ন মার্কিন ডলার) ক্ষতি হয়, যা তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ১০ শতাংশ। ফ্রান্সের প্রবাসী অঞ্চল বিষয়ক মন্ত্রী ম্যানুয়েল ভ্যালস শনিবারের এই চুক্তিকে একটি ‘বুদ্ধিদীপ্ত সমঝোতা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, এর মাধ্যমে ফ্রান্স ও নিউ ক্যালেডোনিয়ার সম্পর্ক বজায় থাকার পাশাপাশি প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপপুঞ্জটি আরও বেশি সার্বভৌমত্ব পাবে।

আলোচনায় অংশগ্রহণকারী কানাক আইনপ্রণেতা এমানুয়েল তিজিবাও বলেন, “এই চুক্তি সহিংসতার চক্র থেকে বেরিয়ে আসতে সাহায্য করবে।” অন্যদিকে, ফ্রান্সের সঙ্গে থাকার পক্ষের আইনপ্রণেতা নিকোলাস মেটজডর্ফ এই সমঝোতাকে ‘কঠোর আলোচনার ফল’ বলে উল্লেখ করেছেন। নিউ ক্যালেডোনিয়ান জাতীয়তাকে তিনি ‘একটি বড় ছাড়’ হিসেবেও বর্ণনা করেন।

প্যারিস থেকে প্রায় ১৭ হাজার কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নিউ ক্যালেডোনিয়া উনিশ শতকের শুরু থেকেই ফ্রান্সের শাসনাধীন। অনেক কানাক আদিবাসী এখনও ফরাসি শাসন নিয়ে অসন্তুষ্ট এবং তারা আরও বেশি স্বায়ত্তশাসন বা পূর্ণ স্বাধীনতা চান। ২০২১ সালে অঞ্চলটিতে সর্বশেষ স্বাধীনতা গণভোট অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা কানাকদের বর্জনের কারণে প্রশ্নবিদ্ধ হয়।