গাজায় দখলদারিত্বের প্রশ্নে অনড় ইসরায়েল, নতুন মানচিত্রের প্রস্তাব

গাজা উপত্যকায় যুদ্ধবিরতি আলোচনা যখন স্থবির হয়ে পড়েছে, তখন অচলাবস্থা ভাঙতে একটি নতুন সেনা প্রত্যাহার মানচিত্র পেশ করতে যাচ্ছে ইসরায়েল। গাজার একটি বড় অংশজুড়ে দখলদারিত্ব বজায় রাখার ইসরায়েলি জেদের কারণেই কাতারে চলমান আলোচনা বাধাগ্রস্ত হয়। শনিবার গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

ইসরায়েলের চ্যানেল টুয়েলভ জানিয়েছে, মধ্যস্থতাকারীরা ইসরায়েলের পক্ষ থেকে নতুন এই মানচিত্র জমা দেওয়ার অপেক্ষায় রয়েছেন।

পূর্বের আলোচনায় হামাস গাজার অভ্যন্তরে ০.৭ থেকে ১ কিলোমিটার প্রশস্ত একটি নিরাপত্তামূলক বাফার অঞ্চলে সম্মত হয়েছিল। কিন্তু ইসরায়েল তাদের সর্বশেষ প্রস্তাবে প্রায় ৩ কিলোমিটার প্রশস্ত এলাকা নিজেদের দখলে রাখার পরিকল্পনা জানায়, যার ফলে আলোচনা থেমে যায়। ধারণা করা হচ্ছে, নতুন মানচিত্রে উভয় পক্ষের মধ্যকার ব্যবধান কমানোর চেষ্টা করা হবে।

‘হারেৎজ’ পত্রিকা একজন আরব কূটনৈতিক সূত্রের বরাত দিয়ে জানিয়েছে, মতবিরোধ সত্ত্বেও মধ্যস্থতাকারী দেশগুলো হাল ছাড়েনি। সূত্রটি জানায়, তারা একদিকে হামাস, যারা পূর্ববর্তী ইসরায়েলি মানচিত্র প্রত্যাখ্যান করেছে এবং অন্যদিকে ইসরায়েলি সরকারের কট্টরপন্থী অংশ, যারা বাস্তবসম্মত ছাড় দিতে নারাজ, উভয়ের মধ্যে ভারসাম্য আনার চেষ্টা করছে।

জানা গেছে, ইসরায়েলের প্রস্তাবে যুক্তরাষ্ট্রও অসন্তুষ্ট। দেশটি তাদের উদ্বেগ কাতার ও মিশরীয় মধ্যস্থতাকারীদের জানিয়েছে।

এদিকে, ইসরায়েলের রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম ‘কান’ জানিয়েছে, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ঘনিষ্ঠ সূত্রগুলো মনে করছে, যদি কোনো যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়, তবে কট্টরপন্থী জাতীয় নিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির পদত্যাগ করতে পারেন। নেতানিয়াহু তার মন্ত্রিসভার অভ্যন্তরীণ বিরোধিতা সামাল দেওয়ার লক্ষ্যে কট্টরপন্থী অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোট্রিচের সঙ্গে বৈঠক করার পরিকল্পনা করছেন বলেও জানা গেছে।

‘দ্য টাইমস অব ইসরায়েল’ এর মতে, ইসরায়েলের প্রত্যাখ্যাত প্রস্তাবে দেখা যায়, তারা গাজার প্রায় এক-তৃতীয়াংশ ভূখণ্ডের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে চেয়েছিল। এর মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলীয় রাফাহ শহরও অন্তর্ভুক্ত, যেখানে ইসরায়েল একটি “মানবিক সহায়তা শহর” প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছিল। এই স্থানটিকে ফিলিস্তিনিদের তৃতীয় কোনো দেশে নির্বাসিত করার উদ্দেশ্যে আটক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের পরিকল্পনা ছিল।

যুদ্ধবিরতি আলোচনার প্রেক্ষাপট

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প পূর্বে ঘোষণা দিয়েছিলেন যে, ইসরায়েল গাজায় ৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির জন্য প্রয়োজনীয় শর্তে সম্মত হয়েছে এবং এই প্রস্তাবটি কাতার ও মিশরের মাধ্যমে হামাসের কাছে উপস্থাপন করা হয়েছে।

হামাস এই প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে জানিয়েছিল, তারা যুদ্ধবিরতি চুক্তি বাস্তবায়ন এবং জিম্মি বিনিময়ের জন্য আলোচনা এগিয়ে নিতে প্রস্তুত। যদিও ইসরায়েল দাবি করেছিল যে, কাতারের প্রস্তাবে হামাসের আনা সংশোধনগুলো গ্রহণযোগ্য নয়, তবুও তাদের একটি প্রতিনিধিদল আলোচনার জন্য দোহায় গিয়েছিল।

দোহায় অনুষ্ঠিত আলোচনায় ৬০ দিনের অস্থায়ী যুদ্ধবিরতি, ১০ জন জীবিত ও ১৮ জন মৃত ইসরায়েলি জিম্মির মুক্তি এবং একটি স্থায়ী যুদ্ধবিরতির বিষয়ে আলোচনার ওপর জোর দেওয়া হয়। যদিও অনেক বিষয়ে সমাধান হয়েছে বলে জানা যায়, মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় গাজার সীমানা বরাবর দখলদারিত্ব বজায় রাখার ইসরায়েলি জেদ।

এমনকি যুদ্ধবিরতি চুক্তি হলেও ইসরায়েল রাফাহতে তাদের উপস্থিতি বজায় রাখার এবং ফিলিস্তিনিদের অন্য দেশে নির্বাসিত করার লক্ষ্যে একটি “আটক শিবির” স্থাপনের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছে।

উল্লেখ্য, গত বছরের অক্টোবর থেকে অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী এবং অবৈধ বসতি স্থাপনকারীদের আক্রমণে অন্তত ৯৯৮ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ৭,০০০ জনেরও বেশি আহত হয়েছেন বলে ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে। গাজায় ইসরায়েলি হামলায় নিহত ফিলিস্তিনির সংখ্যা প্রায় ৫৮,০০০, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।

গত জুলাই মাসে আন্তর্জাতিক বিচার আদালত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে কয়েক দশক ধরে চলা ইসরায়েলি দখলদারিত্বকে অবৈধ ঘোষণা করে এবং পশ্চিম তীর ও পূর্ব জেরুজালেম থেকে সমস্ত বসতি সরিয়ে নেওয়ার দাবি জানায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গত নভেম্বরে প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এবং তার সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধ ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের জন্য গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে। গাজায় চালানো আগ্রাসনের জন্য ইসরায়েল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলারও মুখোমুখি।