‘পাওয়েল একজন বোকা ও নির্বোধ’: ফেড চেয়ারম্যানের ওপর ট্রাম্পের নজিরবিহীন আক্রমণ

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলকে ২৩ বার অপমানসূচক মন্তব্য করে আক্রমণ করেছেন। যদিও তার এই সমালোচনামূলক বক্তব্য বাজারে প্রত্যাশিত প্রভাব ফেলতে পারেনি। শক্তিশালী অর্থনৈতিক তথ্যপ্রবাহ এবং ইতিবাচক উন্নয়ন বাজারের ওপর এর প্রভাব সীমিত রেখেছে।

আনুষ্ঠানিকভাবে সংকলিত তথ্য অনুযায়ী, ট্রাম্প জানুয়ারিতে একবার, এপ্রিলে সাতবার, মে মাসে তিনবার, জুনে আটবার এবং জুলাইয়ের শুরু থেকে চারবার পাওয়েলের সমালোচনা করেছেন।

ট্রাম্প ফেডারেল রিজার্ভের (ফেড) চেয়ারম্যানকে সরাসরি ‘সম্পূর্ণ নির্বোধ’, ‘বড় মাপের ব্যর্থ ব্যক্তি’, ‘বোকা’, ‘অন্যতম বোকা’ এবং ‘গর্দভ’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করে অপমান করেছেন। একইসঙ্গে তিনি পাওয়েলকে সুদের হার কমানোর জন্য চাপ দেন, অন্যথায় তাকে বরখাস্ত করা হবে বলেও হুমকি দেন।

এর মধ্যে ১১টি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এবং ১২টি মৌখিকভাবে দেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা, সাক্ষাৎকার, সংবাদ বিজ্ঞপ্তি এবং ভাষণ অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র নয় দিনের মাথায় ট্রাম্প পাওয়েলের কঠোর সমালোচনা শুরু করেন। নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেন, পাওয়েল এবং ফেড মুদ্রাস্ফীতির সমস্যা মোকাবিলায় ব্যর্থ হয়েছে, যা তাদের কারণেই সৃষ্টি হয়েছে।

এপ্রিলে ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লেখেন, ‘ফেড চেয়ারম্যান জেরোম পাওয়েলের জন্য সুদের হার কমানোর এটাই সেরা সময়।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমেরিকার জন্য একটি বড় বিজয়। জেরোম, সুদের হার কমাও এবং রাজনীতি বন্ধ করো!’

তিনি পাওয়েলকে ‘জনাব বড্ড দেরি’ বলেও অভিহিত করেন এবং বলেন, সুদের হার না কমালে অর্থনীতিতে মন্দা দেখা দিতে পারে। পাওয়েলকে বরখাস্ত করার ক্ষমতা না থাকা সত্ত্বেও সে বিষয়ে কথা বলার পর, পরবর্তী সময়ে ট্রাম্প বলেন যে তিনি ফেড চেয়ারম্যানকে বরখাস্ত করার কথা ভাবছেন না।

মে মাসে এনবিসি নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, তিনি সুদের হারের কারণে পাওয়েলকে অপসারণ করবেন না, তবে উল্লেখ করেন যে, ‘তার হার কমানো উচিত।’

তিনি বলেন, ‘এবং কোনো এক সময়ে সে তা করবে। সে এটা করতে চায় না কারণ সে আমার ভক্ত নয়, আপনি জানেন। সে আমাকে পছন্দ করে না কারণ আমি মনে করি সে একজন আড়ষ্ট প্রকৃতির মানুষ।’

পরে তিনি বলেন, পাওয়েলের কোনো ধারণা নেই এবং তার সাথে কথা বলা দেয়ালে কথা বলার মতো। তিনি ব্যাংক অব ইংল্যান্ড এবং পিপলস ব্যাংক অব চায়নার উদাহরণ দেন, যারা সেই সময়ে সুদের হার কমিয়েছিল, যখন ফেড তা করেনি।

পাওয়েলের প্রতি ট্রাম্পের সবচেয়ে সমালোচনামূলক বক্তব্যগুলো জুন মাসেই এসেছে। জুনে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, মে মাসে এডিপি বেসরকারি খাতের চাকরিসংখ্যা মাত্র ৩৭,০০০ বৃদ্ধি পায়, যা ২০২৩ সালের মার্চের পর থেকে সবচেয়ে খারাপ পরিসংখ্যান।

তথ্যটি উল্লেখ করে ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ লেখেন, ‘এডিপির সংখ্যা প্রকাশ পেয়েছে!!! ‘বড্ড দেরি’ পাওয়েলকে এখনই সুদের হার কমাতে হবে। সে অবিশ্বাস্য।’ অভিষেকের পর পাওয়েলের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের এক সপ্তাহ পরেই ফেড চেয়ারম্যানকে চাপ দেওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি এই মন্তব্য করেন।

ট্রাম্প এক পোস্টে বলেন, যদি তিনি কোনোভাবে পাওয়েলকে বরখাস্ত করেন তাহলে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে—এমন কথার সঙ্গে তিনি একমত নন এবং এটিকে ‘ভিত্তিহীন খবর’ বলে অভিহিত করেন। হোয়াইট হাউসের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, তিনি নিজে ফেডের নেতৃত্ব দিলে আরও ভালো কাজ করতে পারতেন।

মাসের শেষের দিকে তিনি পাওয়েলকে ‘সরকারের অন্যতম বোকা এবং সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক ব্যক্তি’ বলে অভিহিত করেন এবং বলেন, ‘বড্ড দেরি’ আমেরিকার জন্য একটি লজ্জা।

অন্য একটি পোস্টে তিনি প্রশ্ন তোলেন, কেন বোর্ড অব গভর্নরস্‌ পাওয়েলকে বরখাস্ত করেনি। পরে তিনি কংগ্রেসের কাছে আবেদন করেন যেন ফেড চেয়ারম্যানের আসন্ন ভাষণের আগে তাঁর বিরুদ্ধে কিছু একটা করা হয়। তিনি উল্লেখ করেন, পাওয়েলের অযোগ্যতার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে মূল্য দিতে হবে।

হেগে ন্যাটো সম্মেলনে ট্রাম্প পাওয়েলকে ‘গড় বুদ্ধিমত্তার মানুষ’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি বলেন, ‘সে যা করে, তার জন্য তার বুদ্ধিমত্তা কম। আমি মনে করি সে আসলে একজন অত্যন্ত বোকা লোক।’

জুলাই মাসেও ট্রাম্প সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলার সময় পাওয়েলকে বিভিন্ন নামে ডাকতে থাকেন। তিনি বলেন, পাওয়েলের জায়গায় বসানোর মতো বিকল্প তাঁর কাছে রয়েছে। একইসাথে ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ তিনি পাওয়েলকে পদত্যাগ করতে এবং সুদের হার কমাতে বলেন।

পাওয়েলকে অপসারণের বিষয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, তাঁর প্রশাসন এখনো কিছু করার পরিকল্পনা করছে না, তবে তারা বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন।

মে মাসে সুপ্রিম কোর্ট জানায়, পাওয়েলকে অপসারণ করতে হলে ট্রাম্পের একটি বৈধ কারণ বা যুক্তি দেখাতে হবে।

এদিকে, হোয়াইট হাউসের মুখপাত্র ক্যারোলিন লেভিট ট্রাম্পের একটি হাতে লেখা নোট দেখানোর দুই সপ্তাহ পর, ১১ জুলাই, অফিস অব ম্যানেজমেন্ট অ্যান্ড বাজেটের (ওএমবি) পরিচালক রাসেল ভাউট বলেন, ফেড সদর দপ্তরের জন্য পাওয়েলের ২.৫ বিলিয়ন ডলারের পরিকল্পিত সংস্কারকাজ অবৈধ।

ভাউট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বলেন, ‘ফেডের আর্থিক অবস্থার উন্নতির চেষ্টা না করে, আপনি আপনার ওয়াশিংটন ডিসির সদর দপ্তরের একটি জাঁকজমকপূর্ণ সংস্কারের দিকে এগিয়ে গেছেন।’

জুনে সংস্কারের ব্যয় ১.৯ বিলিয়ন থেকে ২.৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হওয়া নিয়ে সিনেটে সাক্ষ্য দেওয়ার পর ভাউট পাওয়েলকে মিথ্যা বলার জন্য অভিযুক্ত করেন।

পাওয়েল জোর দিয়ে বলেন, এই সংস্কারকাজ বিলাসবহুল নয়। তিনি বলেন, ‘এখানে কোনো ভিআইপি খাবারের ঘর নেই, কোনো নতুন মার্বেল নেই। কোনো বিশেষ লিফটও নেই, কেবল পুরোনো লিফটগুলোই রয়েছে।’

ফেডের ২০২২ সালের ৩০ নভেম্বরের বাজেট নথি অনুসারে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংস্কারের অতিরিক্ত ব্যয়ের কারণ হিসেবে ‘কাঁচামালের উল্লেখযোগ্য মূল্যবৃদ্ধি’, ‘শ্রমিকদের উচ্চ মজুরি’ এবং ‘নির্মাণ সময়সূচির পরিবর্তনে প্রত্যাশা’কে উল্লেখ করেছে।

এই ঘটনাবলির প্রতিক্রিয়ায় ট্রাম্প ‘ট্রুথ সোশ্যালে’ এক পোস্টে বলেন, ‘আমি বলতে চাচ্ছি, ২.৫ বিলিয়ন ডলারের সংস্কারের সঙ্গে জালিয়াতি জড়িত থাকাও সম্ভব।’