আপনি পড়ছেন

গাজায় ইসরায়েলের নির্মম গোলাবর্ষণ এবং সেখানকার ফিলিস্তিনিদের পরিকল্পিতভাবে অনাহারে রাখার বিভীষিকাময় পরিস্থিতির মাঝেও এক চিলতে আশা নিয়ে বেঁচে ছিলেন মীরা। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে কানাডার ইউনিভার্সিটি অব রেজাইনা থেকে একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাবৃত্তিসহ ভর্তির সুযোগ পান তিনি। কিন্তু ভিসা প্রক্রিয়াকরণের দীর্ঘসূত্রতায় তার সেই স্বপ্ন এখন ঘোর অনিশ্চয়তায় পড়েছে।

ছবি - সংগৃহীত

আনাতোলু সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মীরা বলেন, ‘আমি অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে এই শিক্ষাবৃত্তির জন্য আবেদন করেছিলাম। আমি তখন রাফাহ্‌র একটি তাঁবুতে বাস্তুচ্যুত পরিবারের সঙ্গে থাকছিলাম। পরিস্থিতি খুব কঠিন ছিল। কিন্তু এটি আমাকে স্বপ্ন দেখা থেকে থামাতে পারেনি। আমি বিশ্বাস করতাম, একদিন আমি আমার লক্ষ্যে পৌঁছাব এবং স্বপ্নকে সত্যি করব।’

পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাবৃত্তি পেয়ে উচ্চশিক্ষার স্বপ্নপূরণের পথে এক ধাপ এগিয়ে গেলেও প্রায় এক বছর ধরে কানাডার শিক্ষা ভিসার জন্য আবেদন করে গাজাতেই আটকা পড়ে আছেন মীরা।

তিনি জানান, কানাডীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তার আবেদনের বিষয়ে কোনো হালনাগাদ তথ্যই তিনি পাননি। মীরা বলেন, ‘আমি ২০২৪ সালের জুলাই মাসে ভিসার জন্য আবেদন করি। কিন্তু এখন পর্যন্ত প্রায় এক বছর হতে চলল, অভিবাসন দপ্তরের কাছ থেকে কোনো উত্তর পাইনি।’ এই বিলম্ব তাকে গভীরভাবে হতাশ করেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।

‘এই বিলম্ব আমাদের শিক্ষাজীবন এবং দৈনন্দিন জীবন, উভয়কেই অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলেছে’, বলেন মীরা।

ইসরায়েলের বারবার উচ্ছেদ আদেশের ফলে গাজা ভূখণ্ডের ৮৮ শতাংশ এলাকাই এখন হয় সামরিক অঞ্চল, নয়তো উচ্ছেদ আদেশের অধীন। এমন পরিস্থিতিতে মীরার মতো অনেক গাজাবাসীকেই দশবারের বেশি বাস্তুচ্যুত হতে হয়েছে। তার পরিবার বাবার চিকিৎসার জন্য মিশর যেতে পারলেও, রাফাহ্‌ সীমান্ত পারাপার পথ বন্ধ হওয়ার মাত্র কয়েকদিন আগে তিনি পেছনে আটকা পড়েন।

গাজার দুঃসহ জীবনের বর্ণনা দিতে গিয়ে মীরা বলেন, ‘আমরা শুধু মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছি না, আমরা অনাহারেরও সম্মুখীন হচ্ছি, যা কখনও কখনও মৃত্যুর চেয়েও কঠিন। বাড়ির বাইরে গেলে বোমার শব্দে ভয় হয়, কিন্তু সেই ভয়টা ক্ষণস্থায়ী। ক্ষুধার অনুভূতি কখনওই যায় না।’

তিনি আরও বলেন, প্রতিদিন চোখের সামনে পরিচিত মানুষদের একে একে নিহত হতে দেখা কতটা কঠিন। ‘প্রতিদিন আমরা ঘুম থেকে উঠি পরিচিত কারও নিহত বা আহত হওয়ার খবর শুনে। আমরা মৃতের তালিকায় নিজেদের নাম দেখতে চাই না। আমরা brilhant প্রকৌশলী এবং অধ্যাপক হিসেবে পরিচিত হতে চাই, কারণ আমরা এর যোগ্য।’

নিজের জীবনের শঙ্কার কথা বলতে গিয়ে মীরা তার দুই সহকর্মী ডালিয়া ও স্যালির কথা স্মরণ করেন। তিনি বলেন, ‘আমি আমার জীবন হারানোর ভয়ে আছি। আমরা ইতোমধ্যেই আমাদের দুই সহকর্মী ডালিয়া ও স্যালিকে হারিয়েছি। তারা কানাডার ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুতে পিএইচডি করার সুযোগ পেয়েছিল, কিন্তু ইসরায়েলি বোমায় নিহত হওয়ায় তাদের স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি।’

দুইবার ভর্তির সময় পেছানোর পর, কানাডার ভিসা দীর্ঘসূত্রতার কারণে মীরা এখন তার ভর্তি এবং শিক্ষাবৃত্তি দুটোই হারানোর ঝুঁকিতে রয়েছেন। তিনি বলেন, ‘সত্যি বলতে, কানাডা সরকারের কাছ থেকে কোনো সাড়া না পাওয়ায় আমি ধীরে ধীরে আশা হারিয়ে ফেলছি। শিক্ষাবৃত্তিটি পাওয়া সহজ ছিল না, তাই এটি হারালে আমার জন্য তা হবে অত্যন্ত বেদনাদায়ক।’

রেজাইনা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া ভর্তির সুযোগপত্রটিকে ‘এক টুকরো আশা’ হিসেবে বর্ণনা করে মীরা বলেন, এটিই তাকে প্রতিদিন বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। ‘যখনই আমি বিষণ্ণ ও ক্লান্ত বোধ করি, আমি মনে করি আমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। আমাকে শক্তিশালী থাকতে হবে এবং ভাবতে হবে যে সুদিন আসবে।’

মীরা জানান, কানাডার ‘বিশ্বজুড়ে সম্মানিত’ খ্যাতি, ‘উচ্চমানের শিক্ষা’ এবং ‘বৈচিত্র্যময় ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজব্যবস্থার’ কারণেই তিনি দেশটিকে বেছে নিয়েছিলেন।

কানাডার রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব

মীরা বলেন, ‘কিন্তু আমার অভিজ্ঞতায় এর কোনো প্রতিফলন পাইনি।’ তিনি ফ্রান্স, ইতালি ও আয়ারল্যান্ডের উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই দেশগুলো গাজা থেকে শিক্ষার্থীদের সরিয়ে নিতে এবং ভিসা দিতে দ্রুত পদক্ষেপ নিয়েছে।

তবে মীরার এই গল্প বিচ্ছিন্ন কোনো ঘটনা নয়।

প্যালেস্টিনিয়ান স্টুডেন্টস অ্যান্ড স্কলার্স অ্যাট রিস্ক (পিএসএসএআর) নামের একটি বেসরকারি সংস্থার পরিচালক নাদা আল-ফালু আনাতোলুকে জানান, তাদের সংস্থা ‘ইউনিভার্সিটি অব ব্রিটিশ কলাম্বিয়া, ইউনিভার্সিটি অব টরন্টো এবং ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলুর মতো কানাডার শীর্ষস্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ৭০ জনেরও বেশি শিক্ষার্থীকে ভর্তির সুযোগ পেতে সাহায্য করেছে।’

তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘এই শিক্ষার্থীরা সম্পূর্ণরূপে মেধার ভিত্তিতে ভর্তির সুযোগ পেয়েছে, তারা কোনো করুণা পাচ্ছে না।’

নাদা জানান, মাসের পর মাস, এমনকি কিছু ক্ষেত্রে এক বছরেরও বেশি সময় আগে আবেদন শেষ করার পরও তাদের শিক্ষা ভিসা ঝুলে আছে। ‘আমাদের এমন শিক্ষার্থীও আছে যারা ১২ থেকে ১৬ মাস ধরে শুধু তাদের শিক্ষা ভিসার জন্য অপেক্ষা করছে। তাদের আবেদন প্রত্যাখ্যানও করা হচ্ছে না, শুধু প্রক্রিয়া করা হচ্ছে না।’

ডালিয়া ও স্যালির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করে নাদা বলেন, ‘ভর্তির সুযোগ পাওয়ার পর আমাদের পিএসএসএআর-এর দুজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছে।’

ফ্রান্স, ইতালি ও আয়ারল্যান্ডের মতো দেশগুলোর দ্রুত পদক্ষেপের বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, ‘সমস্যাটা এটা নয় যে কাজটি করা সম্ভব নয়। সমস্যা হলো কানাডা এটা করতে চায় না এবং কানাডার রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব রয়েছে।’

অভিবাসন, শরণার্থী ও নাগরিকত্ব বিষয়ক কানাডীয় দপ্তর (আইআরসিসি) আনাতোলুকে জানিয়েছে, তারা ‘গাজার চলমান পরিস্থিতি নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন এবং সেখানকার মানুষের কঠিন পরিস্থিতি অনুধাবন করে।’

সংস্থাটি বলেছে, ‘গাজায় থাকা কানাডীয় নাগরিক এবং স্থায়ী বাসিন্দাদের বর্ধিত পরিবারের সদস্যদের জন্য কানাডা বিশেষ ব্যবস্থা চালু করেছে’ এবং ‘সংকটাপন্ন ফিলিস্তিনিরা কানাডায় আসার পর অস্থায়ী আর্থিক সহায়তা পাবে।’ তবে আইআরসিসি এও স্পষ্ট করে দিয়েছে, ‘কানাডার কোনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আবেদন করা কানাডায় প্রবেশের নিশ্চয়তা দেয় না।’

অন্যান্য দেশের দ্রুত পদক্ষেপের বিষয়ে আইআরসিসি দাবি করে, ‘গাজায় ইসরায়েল-হামাস সংকটে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য অস্থায়ী ব্যবস্থা ঘোষণাকারী প্রথম কয়েকটি দেশের মধ্যে কানাডা অন্যতম।’

তারা আরও জানায়, ‘সব আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীকে শিক্ষা ভিসা অনুমোদনের আগে কিছু শর্ত পূরণ করতে হয়। এর মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক নিরাপত্তা যাচাইয়ের জন্য বায়োমেট্রিক তথ্য প্রদান। কিন্তু গাজার অনেক আবেদনকারী সেখান থেকে বের হয়ে এই ধাপগুলো সম্পন্ন করতে পারছেন না।’

তবে পিএসএসএআর-এর তথ্য অনুযায়ী, এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষার্থী ইতোমধ্যেই গাজা থেকে বেরিয়ে মিশর বা জর্ডানে অবস্থান করছে, কিন্তু তাদের ভিসাও প্রক্রিয়া করা হচ্ছে না।

নাদা আল-ফালু বলেন, ‘এটি কোনো কারিগরি বা আমলাতান্ত্রিক সমস্যা নয়। এটি রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব এবং শিক্ষার অধিকারকে সমর্থন করার কানাডীয় ঐতিহ্যের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা। ফিলিস্তিনিদের প্রতি এই উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পক্ষপাতদুষ্ট প্রক্রিয়ার পরিবর্তন প্রয়োজন।’

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.