দেশের ৩১টি ব্যাংক ২০২৪ সালে সম্মিলিতভাবে শেয়ারবাজারে প্রায় ৩ হাজার ৬০০ কোটি টাকা লোকসান গুনেছে। শেয়ার বিক্রি না করেও দামের পতনের কারণে পোর্টফোলিওর মূল্য কমে যাওয়ায় এই বিপুল ‘আনরিয়ালাইজড’ ক্ষতি হয়েছে।

প্রতীকী ছবি

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংকগুলোর এই লোকসানের পেছনে রয়েছে ‘জাঙ্ক স্টক’-এ বেপরোয়া বিনিয়োগ, দক্ষ পোর্টফোলিও ম্যানেজারের অভাব এবং রাজনৈতিক অস্থিরতায় বাজারের দীর্ঘ পতন। এই ধাক্কা পুরো ব্যাংক খাতের জন্য একটি বড় সতর্কবার্তা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলোর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে। জনতা ব্যাংক এককভাবে প্রায় ৪০০ কোটি টাকা হারিয়েছে। তাদের পোর্টফোলিওতে বেক্সিমকো সুকুক বন্ড, বাংলাদেশ ফিক্সড ইনকাম ফান্ড, সামিট পাওয়ার ও বেস্ট হোল্ডিংসে বড় অঙ্কের বিনিয়োগ ছিল। এছাড়া এবি ব্যাংক, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পিপলস লিজিং, ফিনিক্স ফাইন্যান্স, প্রাইম ফাইন্যান্স ও ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের মতো দীর্ঘদিন ধরে সমস্যায় জর্জরিত প্রতিষ্ঠানে ৫০ কোটির বেশি টাকার ‘জাঙ্ক স্টক’ রয়েছে জনতা ব্যাংকের।

অন্যান্য বড় ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকের তালিকায় সোনালী ব্যাংক ৩৯৮ কোটি, ইস্টার্ন ব্যাংক ৩৫৩ কোটি এবং সাউথইস্ট ব্যাংক ৩২৬ কোটি টাকা লোকসান করেছে। এবি ব্যাংক, এক্সিম ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক ও অগ্রণী ব্যাংকের লোকসান প্রত্যেকটির ২০০ কোটির বেশি। এছাড়া উত্তরা ব্যাংক, এনসিসি ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, এনআরবি কমার্শিয়াল ব্যাংক ও শাহজালাল ইসলামী ব্যাংকের ক্ষতি ১০০ থেকে ২০০ কোটি টাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। স্থানীয় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ না করায় বিদেশি ব্যাংকগুলো এই ক্ষতি থেকে রেহাই পেয়েছে।

এই বিপর্যয়ের পেছনে বেক্সিমকো গ্রুপের গ্রিন সুকুক বন্ডের ভূমিকা ছিল লক্ষণীয়। ২০২৪ সালের মাঝামাঝি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গ্রুপটির মালিক সালমান এফ রহমান গ্রেফতার হলে বাজারে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে সুকুকের দাম প্রায় অর্ধেকে নেমে ৪০ টাকায় দাঁড়ায়। বিশ্লেষকরা আরও উল্লেখ করেছেন, আইসিবি ইসলামিক ব্যাংক ও পিপলস লিজিংয়ের মতো ডুবন্ত প্রতিষ্ঠানে কিছু ব্যাংকের বিনিয়োগ ছিল, যা ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

এদিকে একসময়ের শীর্ষ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৩২ বছরের মধ্যে প্রথমবারের মতো ২০২৪ সালের জন্য কোনো লভ্যাংশ ঘোষণা করতে পারেনি। চট্টগ্রামভিত্তিক এস আলম গ্রুপের ব্যাপক ঋণ কেলেঙ্কারির কারণে ব্যাংকটিতে ৬৯ হাজার ৭৭০ কোটি টাকার বিশাল প্রভিশন ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে, যা লভ্যাংশ প্রদানে বড় বাধা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) প্রতিবেদন অনুযায়ী, এস আলম গ্রুপ ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ৭৩ হাজার ১১৩ কোটি টাকা ঋণ বের করে নিয়েছে, যা ব্যাংকের মোট ঋণের প্রায় অর্ধেক। এর মধ্যে ৫৬ হাজার ১১৮ কোটি টাকা ছিল সরাসরি ঋণ, ৭ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা পরোক্ষ ঋণ এবং ৯ হাজার ৪৭১ কোটি টাকা স্বার্থসংশ্লিষ্ট ঋণ।

এজ অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও সিইও আলী ইমাম জানান, ব্যাংকগুলোর বিনিয়োগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার ঘাটতিই আসল সমস্যা। পোর্টফোলিও ম্যানেজাররা মন্দাবাজারেও ভালো পারফরম্যান্স করতে পারতেন। ব্যাংকগুলো সাধারণত ঋণ পরিচালনায় দক্ষ কর্মকর্তাদের দিয়ে ইক্যুইটি বিনিয়োগ করিয়েছে, যার ফলস্বরূপ অচল কোম্পানি ও ‘জাঙ্ক স্টক’-এ বিনিয়োগ হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সমস্যার মূল উৎস হলো ‘মালিকানা প্রভাব’। অনেক ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ বা প্রভাবশালী পরিচালকরা তাদের নিজস্ব বা সম্পর্কিত কোম্পানির শেয়ার কিনতে ব্যাংককে চাপ দেন। এর ফলে ব্যাংকের পোর্টফোলিওতে অকার্যকর কোম্পানির শেয়ার ভরে ওঠে। বাংলাদেশ অ্যাকাডেমি ফর সিকিউরিটিজ মার্কেটসের মহাপরিচালক তৌফিক আহমেদ চৌধুরী জানান, ব্যাংকের আসলে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করার কথা নয়, কারণ এর রিটার্ন অনিশ্চিত। তিনি আরও যোগ করেন যে, ‘জাঙ্ক স্টক’-এ ব্যাংকের বিনিয়োগ করা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য।

২০২৪ সালে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) প্রধান সূচক ডিএসইএক্স ১,০২৬ পয়েন্ট বা ১৬ শতাংশ কমে গেলেও, এটি লোকসানের একমাত্র কারণ ছিল না। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে সরাসরি ধস থেকে রক্ষা করতে প্রভিশন বা নিরাপত্তা সঞ্চিতি রাখতে বাধ্য করেছে। তবে এই কঠিন পরিস্থিতিতেও মার্কেন্টাইল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক ও প্রাইম ব্যাংক শেয়ারবাজারে লাভ করতে সক্ষম হয়েছে।

অর্থনীতিবিদদের মতে, ৩১টি ব্যাংকের এই বিপুল লোকসান ব্যাংক খাতের তারল্য ব্যবস্থাপনা ও মুনাফা বণ্টনে চাপ সৃষ্টি করবে এবং দীর্ঘমেয়াদে শেয়ারবাজারেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশ ব্যাংকের এক কর্মকর্তা জানান, ব্যাংকের মূল কাজ ঋণ দেওয়া ও আমানত রক্ষা করা, তাই শেয়ারবাজারে তাদের অতিরিক্ত ঝুঁকি নেওয়া উচিত নয়। তবে ব্যাংকগুলো এখন অসতর্ক বিনিয়োগের ঝুঁকি বুঝতে শুরু করেছে, যা ভবিষ্যতে সঠিক শিক্ষা ও পেশাদার পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে লোকসান কাটিয়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখাচ্ছে।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর

Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.

Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.