সৌদি অপারেটরের গাফিলতি, মুখ থুবড়ে পড়েছে পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দরের পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল (পিসিটি) আধুনিকায়নের লক্ষ্য নিয়ে ২০২৪ সালের জুনে সৌদি আরবভিত্তিক রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনালকে (আরএসজিটিআই) ২২ বছরের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছিল। তবে শুরু হওয়ার ১৫ মাস পরও প্রতিশ্রুত আধুনিক যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও দক্ষ ব্যবস্থাপনার প্রতিফলন দেখা যায়নি। এতে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে মারাত্মক বিঘ্ন ঘটছে এবং ব্যবসায়ী মহলে ক্ষোভ বাড়ছে।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ (সিপিএ) নিজস্ব তহবিল থেকে প্রায় ১ হাজার ২৭০ কোটি টাকা ব্যয়ে টার্মিনালটি নির্মাণ করে, যার বার্ষিক সক্ষমতা ৫ লাখ টিইইউ (২০ ফুট সমতুল্য কনটেইনার)। কিন্তু অপারেটর প্রতিষ্ঠানটির হাতে যাওয়ার পর থেকে এই সক্ষমতার সঠিক ব্যবহার হয়নি।

আরএসজিটিআই শুরুতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছিল এবং গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্ক্যানারসহ আধুনিক সরঞ্জাম আনার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। কিন্তু এখনও সেসব প্রতিশ্রুতি পূরণ হয়নি।

কনটেইনারগুলো পরিকল্পিত ধারণক্ষমতার বাইরে জমে থাকায় মারাত্মক জট সৃষ্টি হয়েছে। এতে কনটেইনার খালাসে ঘণ্টার কাজ দিনের পর দিন লেগে যাচ্ছে। কাঁচামাল সময়মতো না পৌঁছায় কারখানাগুলো উৎপাদন কমাতে বাধ্য হচ্ছে, অন্যদিকে রপ্তানিকারকেরা ডেডলাইন মেনে পণ্য পাঠাতে না পেরে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আস্থা হারানোর ঝুঁকিতে পড়ছেন।

চট্টগ্রাম কাস্টমস এজেন্টস অ্যাসোসিয়েশন (সিসিএএ) ৭ সেপ্টেম্বর সিপিএ চেয়ারম্যানকে দেওয়া এক চিঠিতে আরএসজিটিআইয়ের অদক্ষতা, দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামোগত সমস্যার সমাধানে ব্যর্থতার অভিযোগ করেছে।

টার্মিনালে পর্যাপ্ত গ্যান্ট্রি ক্রেন, স্ক্যানার বা রাবার-টাইয়ার্ড গ্যান্ট্রি ক্রেন (আরটিজি) নেই। ফলে কাজ হচ্ছে খুবই ধীরগতিতে। অনভিজ্ঞ শ্রমিকরা যন্ত্রপাতি চালাচ্ছে, যার ফলে পণ্যের ক্ষতিও হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সিসিএএ নেতা মোহাম্মদ রেজাউল করিম স্বপন বলেন, টার্মিনালটি আধুনিক প্রযুক্তি ও দ্রুত বাণিজ্য কার্যক্রমের প্রতিশ্রুতি নিয়ে শুরু হলেও ১৫ মাস পরও ব্যবসায়ী মহল সেই সুবিধা পায়নি। প্রতিদিনই আমদানিকারক, রপ্তানিকারক ও সিএন্ডএফ এজেন্টদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।

বন্দর সংশ্লিষ্টরা জানান, ট্রায়াল অপারেশনে সিপিএ নিজেই টার্মিনালটি সফলভাবে পরিচালনা করতে পারত বলে প্রমাণিত হয়েছিল। এমনকি ৪৬০ কোটি টাকার সরঞ্জাম কেনার পরিকল্পনাও করা হয়েছিল। কিন্তু চাপের মুখে আরএসজিটিআইয়ের হাতে ব্যবস্থাপনা হস্তান্তর করা হয়। তবু প্রতিষ্ঠানটি এখনো ঘোষিত বিনিয়োগ দেয়নি, ফলে সম্ভাব্য হাজার হাজার কোটি টাকার রাজস্ব হারিয়েছে সরকার।

আরএসজিটিআই জানিয়েছে, সেপ্টেম্বরের মধ্যে চারটি আরটিজি চালু হবে, আরও ১০টি আসবে। আগামী বছরের এপ্রিলের মধ্যে চারটি গ্যান্ট্রি ক্রেনও স্থাপন করা হবে। বর্তমানে মাসে ১৫-১৭ হাজার টিইইউ কনটেইনার হ্যান্ডল করা হলেও যন্ত্রপাতি স্থাপনের পর ৩০ হাজার টিইইউ সামলানোর সক্ষমতা তৈরি হবে।

সিপিএ সচিব মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, ৭ সেপ্টেম্বরের বৈঠকে আরএসজিটিআইকে দ্রুত কার্যক্রম এগিয়ে নিতে বলা হয়েছে। আমরা শিগগির অগ্রগতি আশা করছি। বিনিয়োগ কেবল অর্থনৈতিক নয়, সৌদি আরবের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কও জোরদার করছে।

পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনাল দেশের বন্দর আধুনিকায়নের এক সফল উদাহরণ হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন এটি হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ ও ক্ষতির গল্প।

চট্টগ্রাম চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির সাবেক পরিচালক মাহফুজুল হক শাহ বলেন, বিশ্বখ্যাত অপারেটরকে দায়িত্ব দেওয়ার পর আমরা আন্তর্জাতিক মানের সেবা আশা করেছিলাম। কিন্তু বাস্তবতায় আমরা গভীরভাবে হতাশ।

তিনি সিপিএকে তদন্ত করে চুক্তির দুর্বলতা ও অপারেটরের ব্যর্থতার কারণ খুঁজে বের করার আহ্বান জানান।