এলডিসি থেকে উত্তরণ: আরও তিন বছর সময় চায় বাংলাদেশ

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ তিন বছর পিছিয়ে দেওয়ার জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা শুরু করেছে সরকার। দেশের ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ জানানোর পর সরকার এই উদ্যোগ নিয়েছে। তবে এই প্রক্রিয়ায় বন্ধুরাষ্ট্র জাপান ও তুরস্কের মতো দেশগুলোর সমর্থন আদায় করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

২০২৬ সালের ২৪ নভেম্বর বাংলাদেশের এলডিসি থেকে উত্তরণের কথা রয়েছে। কিন্তু এই উত্তরণ দেশের রপ্তানি খাতসহ সামগ্রিক অর্থনীতির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ তৈরি করতে পারে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা। তাদের মতে, এই মুহূর্তে উত্তরণ ঘটলে রপ্তানিতে শুল্ক প্রায় ১২ শতাংশ বাড়তে পারে, যা আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতার সক্ষমতা কমিয়ে দেবে। ফলে রপ্তানি ৬ থেকে ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, এলডিসি হিসেবে বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক মেধাস্বত্ব চুক্তিতে (ট্রিপস) ছাড় পাওয়ায় ওষুধ শিল্প ব্যাপকভাবে বিকশিত হয়েছে। উত্তরণের পর এই সুবিধা থাকবে না, যা উৎপাদন ব্যয় বাড়াবে এবং বাজার হারানোর ঝুঁকি তৈরি করবে। এছাড়া তৈরি পোশাক, সফটওয়্যার ও কপিরাইটনির্ভর অন্যান্য খাতেও নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে তারা মনে করেন। ইন্টারন্যাশনাল চেম্বার অব কমার্স, বাংলাদেশের (আইসিসিবি) সভাপতি মাহবুবুর রহমান বিদেশি বিনিয়োগ বাধাগ্রস্ত হওয়া এবং জলবায়ু সহনশীলতা অর্জনের জন্য পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ার বিষয়েও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

এ বিষয়ে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানিয়েছেন, সরকার এলডিসি উত্তরণ তিন বছর পেছানোর জন্য চেষ্টা করছে। তবে তিনি এ ব্যাপারে খুব বেশি আশাবাদী নন, কারণ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রস্তাব পাসের জন্য বৃহৎ শক্তিগুলোর সমর্থন প্রয়োজন। অন্যদিকে, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন মনে করেন, পূর্ববর্তী সরকার এলডিসি উত্তরণকে রাজনৈতিক স্লোগান হিসেবে ব্যবহার করলেও বাস্তব প্রস্তুতি নেয়নি। তার মতে, এটি এখন একটি ‘টাইম বোমা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

গবেষণা প্রতিষ্ঠান র‍্যাপিডের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পাল্টা শুল্কের কারণে আগামী এক বছরে বাংলাদেশের রপ্তানি ১৪ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে। তবে বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেনের মতে, উত্তরণ পেছানোর জন্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে শক্তিশালী যুক্তি তুলে ধরতে হবে। তিনি জানান, মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ ও অর্থনৈতিক ভঙ্গুরতা—এই তিনটি সূচকের অন্তত দুটিতে উত্তরণের যোগ্যতার নিচে থাকতে হবে, যা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য মনে করেন, প্রস্তুতির জন্য আট বছর সময় পাওয়ার পর আরও সময় চাওয়াটা জোরালো যুক্তি নয়। তার মতে, এখন মসৃণ উত্তরণের কৌশল, অর্থনীতিতে বৈচিত্র্য আনা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা বাড়ানোর দিকেই মনোযোগ দেওয়া উচিত।

এর আগে মালদ্বীপ, নেপাল, মিয়ানমার ও অ্যাঙ্গোলার মতো দেশগুলো বিভিন্ন সংকট ও দুর্যোগের কারণে এলডিসি থেকে উত্তরণের জন্য অতিরিক্ত সময় পেয়েছিল। তবে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তেমন কোনো বড় ধরনের অপ্রত্যাশিত সংকট না থাকায় সময়সীমা বাড়ানোর যুক্তি প্রতিষ্ঠা করা কঠিন হবে। ১৯৭৫ সালে এলডিসি তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পর গত পাঁচ দশকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক অগ্রগতি অর্জন করেছে। এখন নির্ধারিত সময়ে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে প্রবেশ করবে, নাকি আরও কিছুটা সময় নেবে—সেই সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে আগামী অক্টোবর-নভেম্বরে জাতিসংঘের কমিটি ফর ডেভেলপমেন্ট পলিসির (সিডিপি) মূল্যায়নের ওপর।