গাজায় নতুন এক গোষ্ঠীকে ইসরায়েলের সমর্থন নিয়ে স্কাই নিউজের তদন্তে চাঞ্চল্যকর তথ্য

গাজা উপত্যকায় হামাসবিরোধী একটি সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ইসরায়েল অস্ত্র, অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে আসছে বলে একটি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যমের তদন্তে উঠে এসেছে। ‘পপুলার ফোর্সেস’ নামের এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীটিকে ভবিষ্যৎ গাজার শাসনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় আনার জন্য প্রস্তুত করা হচ্ছে। স্কাই নিউজের এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে এই চাঞ্চল্যকর দাবি করা হয়েছে, যা আরব নিউজ প্রকাশ করেছে।

স্কাই নিউজের তথ্য ও ফরেনসিক শাখার তদন্ত অনুসারে, এই মিলিশিয়া গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্র-সমর্থিত ‘গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন’ (জিএইচএফ) থেকে সহায়তা পাচ্ছে। একই সঙ্গে ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) তাদের নগদ অর্থ, অস্ত্র ও যানবাহন সরবরাহের সুযোগ করে দিচ্ছে। গোষ্ঠীটির প্রধান হিসেবে ইয়াসের আবু শাবাবের নাম উঠে এসেছে, যিনি অতীতে একটি লুটেরা দলের নেতৃত্ব দিতেন। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, ইসরায়েলের এই পদক্ষেপ ফাতাহর বিরুদ্ধে হামাসকে সমর্থন দেওয়ার মতোই একটি ‘বিভাজন করে শাসন’ কৌশলের অংশ।

স্কাই নিউজের দলটি কয়েক মাস ধরে আবু শাবাব ও তার দলের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাজার দক্ষিণাঞ্চলে তুলনামূলকভাবে অক্ষত একটি এলাকায় এই মিলিশিয়ার ঘাঁটি অবস্থিত। সেখানে তাদের পর্যাপ্ত খাদ্য, চিকিৎসাসেবা, একটি বিদ্যালয় এমনকি একটি মসজিদও রয়েছে। বর্তমানে পপুলার ফোর্সেসের ঘাঁটিতে প্রায় দেড় হাজার মানুষ বাস করে, যাদের মধ্যে ৫০০ থেকে ৭০০ জন যোদ্ধা। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে বিভিন্ন প্রলোভন দেখিয়ে অনেককে এই দলে যুক্ত করা হয়েছে এবং পুরো গাজাজুড়ে তাদের মোট যোদ্ধার সংখ্যা প্রায় তিন হাজার।

কারম শালোম ক্রসিং দিয়ে গাজায় প্রবেশকারী ত্রাণবাহী ট্রাকের জিএইচএফ-কে পপুলার ফোর্সেসের ঘাঁটির অবস্থান। এর ফলে তারা সহজেই সাহায্যের বহর লুট করতে পারে। গত নভেম্বরে জাতিসংঘের একটি প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল যে, আবু শাবাব ও তার দলই এই লুটের পেছনে দায়ী।

হাসান আবু শাবাব নামের এক মিলিশিয়া সদস্য জানান, হামাস তাদের বেশ কয়েকজন যোদ্ধাকে হত্যার পর ইসরায়েল বিতর্কিত জিএইচএফ-কে পপুলার ফোর্সেসের ঘাঁটিতে খাদ্য সহায়তা সরবরাহের অনুমতি দেয়। জাতিসংঘের ত্রাণ ও কর্ম সংস্থা এবং নরওয়েজিয়ান শরণার্থী পরিষদের কর্মকর্তারা স্কাই নিউজকে জানিয়েছেন, কোনো সশস্ত্র গোষ্ঠীকে ত্রাণ সরবরাহ করা মানবিক আইন ও নিরপেক্ষতার নীতির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

ইসরায়েল কীভাবে এই মিলিশিয়াকে সাহায্য করছে, সে বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক ইসরায়েলি সেনাসদস্য স্কাই নিউজকে বলেন, ‘ইসরায়েল তাকে সাহায্য করে। তারা তাকে গ্রেনেড দেয়, টাকা দেয়, গাড়ি দেয়, খাবার দেয়, সব রকম জিনিস দেয়।’ পপুলার ফোর্সেসের সদস্যদের টিকটকে প্রকাশিত ভিডিওতে তাদের যানবাহনের বহরে অনেক ইসরায়েলি নিবন্ধন ফলক (লাইসেন্স প্লেট) দেখা গেছে।

তদন্তে মিলিশিয়া ও ইসরায়েলি বিমানবাহিনীর মধ্যে নিবিড় সমন্বয়েরও ইঙ্গিত পাওয়া গেছে। গত ১৩ এপ্রিল হামাস যোদ্ধাদের ওত পেতে করা হামলায় পপুলার ফোর্সেসের চার সদস্য নিহত হয়। এর মাত্র একদিন পরই ইসরায়েলি বাহিনী বিমান হামলা চালিয়ে সেই বাড়িটি ধ্বংস করে দেয়।

আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা ইসরায়েলের এই কৌশলকে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা হিসেবে দেখছেন। লন্ডনের কুইন মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক আইনের অধ্যাপক নেভ গর্ডন বলেন, ‘এই কৌশলের উদ্দেশ্য হলো গাজাকে বিভিন্ন যুদ্ধবাজ নেতার নিয়ন্ত্রণে থাকা অঞ্চলে পরিণত করা, যাতে ফিলিস্তিনিদের মধ্যে কোনো ঐক্য গড়ে উঠতে না পারে।’ একই মত দিয়েছেন ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের জ্যেষ্ঠ বিশ্লেষক আমজাদ ইরাকি। তার মতে, দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের প্রতিরোধ গড়ে তোলার পথ আরও কঠিন করতেই ইসরায়েল এই সমর্থন দিচ্ছে।

তবে এসব অভিযোগের বিষয়ে ইসরায়েল কর্তৃপক্ষ এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানায়নি।