মাত্র সাত মিনিটে ল্যুভরে ১০২ মিলিয়ন ডলারের রত্নচুরি

প্যারিসের বিশ্ববিখ্যাত ল্যুভর জাদুঘরে দুঃসাহসিক চুরির ঘটনায় ক্ষতির পরিমাণ ১০২ মিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে বলে জানিয়েছেন একজন ফরাসি প্রসিকিউটর। মঙ্গলবার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রসিকিউটর লর বেকো জানান, ল্যুভরের কিউরেটর ক্ষতির পরিমাণ ৮৮ মিলিয়ন ইউরো বা প্রায় ১০২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার নির্ধারণ করেছেন, যা একটি ‘অসাধারণ’ ক্ষতি। এই ঘটনা ফ্রান্সের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের ওপর একটি বড় আঘাত বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

লর বেকো আরও বলেন, আর্থিক ক্ষতির চেয়েও ফ্রান্সের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের যে ক্ষতি হয়েছে, তা অপূরণীয়। তিনি বলেন, ‘চোরেরা যদি এ রত্নগুলো গলিয়ে ফেলার মতো ‘মূর্খতাপূর্ণ’ সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে তারা এর প্রকৃত মূল্য পাবে না।’

চুরি হওয়া মূল্যবান রাজকীয় গহনার মধ্যে রয়েছে নেপোলিয়ন বোনাপার্টের স্ত্রী সম্রাজ্ঞী মেরি লুইসকে উপহার দেওয়া পান্না ও হীরার নেকলেস এবং প্রায় দুই হাজার হীরাখচিত সম্রাজ্ঞী ইউজেনির মুকুটসহ আটটি মূল্যবান রাজকীয় অলংকার।

বিভিন্ন ফুটেজ পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, গত রোববার দিনের আলোয় মাত্র সাত মিনিটে চারজনের একটি সংঘবদ্ধ দল ল্যুভর জাদুঘর থেকে এসব অমূল্য রাজকীয় গহনা চুরি করে পালিয়ে যায়। দলটি একটি মালবাহী ট্রাকের ওপর মই লাগিয়ে জাদুঘরের অ্যাপোলো গ্যালারির জানালা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করে। পরে কাটার ব্যবহার করে তারা জানালা এবং কাচের প্রদর্শনী বাক্স ভেঙে মূল্যবান অলংকারগুলো নিয়ে যায়। তবে পালানোর সময় তারা একটি হীরার মুকুট ফেলে যায় বলে জানা গেছে।

এই চুরির ঘটনাটি ফ্রান্সে সাম্প্রতিক মাসগুলোতে জাদুঘরে ঘটে যাওয়া একাধিক চুরির সর্বশেষ সংযোজন। এর ফলে কর্তৃপক্ষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে তৎপর হয়েছে। রোববারের ঘটনায় জড়িতদের ধরতে কয়েক ডজন তদন্তকারী কাজ করছেন। পুলিশ ও তদন্ত কর্মকর্তারা নজরদারি ক্যামেরার ফুটেজ পর্যালোচনা এবং ঘটনাস্থলে পাওয়া আঙুলের ছাপ বিশ্লেষণ করছেন। ফরাসি কর্তৃপক্ষ ধারণা করছে, এটি একটি আন্তর্জাতিক সংগঠিত অপরাধচক্রের কাজ।

এই ঘটনার পর দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে বিতর্ক আরও তীব্র হয়েছে। ল্যুভরে নিরাপত্তার ঘাটতির বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনায় ছিল। ফ্রান্সের কোর্ট অব অডিটরসের এক প্রতিবেদনে দেখা যায়, ২০১৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ল্যুভরের মাত্র এক-চতুর্থাংশ অংশে ভিডিও নজরদারির ব্যবস্থা রয়েছে।

জানুয়ারিতে ল্যুভরের প্রেসিডেন্ট লরেন্স দে কার্স সংস্কৃতি মন্ত্রী রাশিদা দাতিকে সতর্ক করে বলেছিলেন, জাদুঘরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ‘উদ্বেগজনকভাবে পুরোনো হয়ে গেছে এবং এর বড় ধরনের সংস্কার প্রয়োজন’।

গত মাসেই প্যারিসের প্রাকৃতিক ইতিহাস জাদুঘর থেকে প্রায় দেড় মিলিয়ন ডলার মূল্যের স্বর্ণখণ্ড চুরি হয়েছিল। মঙ্গলবার ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানায়, ওই ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে ২৪ বছর বয়সী এক চীনা নারীকে বার্সেলোনায় গ্রেপ্তার করে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে এবং তার কাছ থেকে প্রায় এক কেজি গলিত সোনা উদ্ধার করা হয়েছে। শুধু প্যারিস নয়, একই মাসে ফ্রান্সের লিমোজ শহরের একটি জাদুঘর থেকেও প্রায় সাত দশমিক ছয় মিলিয়ন ডলার মূল্যের দুটি দামি থালা ও একটি ফুলদানি চুরি হয়।

ফরাসি কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, সাংস্কৃতিক সম্পদের অবৈধ পাচারবিরোধী কেন্দ্রীয় দপ্তর এসব চুরিকে ‘সাংস্কৃতিক সম্পদের বিরুদ্ধে ক্রমবর্ধমান হামলা’ হিসেবে দেখছে।

এদিকে, সমালোচনার জবাবে জাদুঘরের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চুরি হওয়া অলংকারের কাচের বাক্সগুলো ২০১৯ সালে স্থাপন করা হয়েছিল এবং সেগুলো নিরাপত্তামানের দিক থেকে যথেষ্ট উন্নত ছিল। তবে শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর অভিযোগ, জাদুঘরে দর্শনার্থীর সংখ্যা দ্রুত বাড়লেও নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যা কমিয়ে ফেলা হয়েছে, যা এ ধরনের দুর্ঘটনার সুযোগ তৈরি করছে।

রোববারের চুরির পর সোমবার ও মঙ্গলবার ল্যুভর জাদুঘর বন্ধ থাকায় বহু পর্যটককে হতাশ হয়ে ফিরে যেতে হয়।