গলওয়ানের ক্ষত ভুলিয়ে দিয়েছে বাণিজ্য, চীনের ওপর আরও নির্ভরশীল ভারত
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০২০ সালে গলওয়ান উপত্যকায় ২০ জন ভারতীয় সেনাসদস্যের নিহতের ঘটনায় ‘বয়কট চায়না’ স্লোগানে উত্তাল হয়ে উঠেছিল পুরো ভারত। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও সে সময় ‘আত্মনির্ভর ভারত’ কর্মসূচির প্রচারণা জোরেশোরে শুরু করেন। অনেকেই তখন ধারণা করেছিলেন, এই ঘটনার পর চীনের সঙ্গে ভারতের বাণিজ্যিক সম্পর্কে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে চলেছে।

কিন্তু পাঁচ বছর পর এসে চিত্রটি সম্পূর্ণ বিপরীত। সীমান্তে উত্তেজনা এখনও বহাল থাকলেও ভারতীয় বাজারে চীনা পণ্যের স্রোত আরও বেড়েছে। ওষুধ তৈরির কাঁচামাল থেকে শুরু করে বিরল খনিজ, ব্যাটারি এবং সৌর প্যানেল—প্রায় সব ক্ষেত্রেই চীনের ওপর নির্ভরতা বেড়েছে ভারতের। ফলে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে, যা নিয়ে মোদি সরকারের কপালে চিন্তার ভাঁজ এখন স্পষ্ট।
চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (এপ্রিল-অক্টোবর) চীনে ভারতের রপ্তানি প্রায় ১১ শতাংশ বেড়ে ছয় হাজার ৪০০ কোটি ডলারে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু একই সময়ে চীন থেকে আমদানি বেড়েছে তার চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলে বাণিজ্য ঘাটতি গত বছরের তুলনায় আরও প্রশস্ত হয়েছে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে ভারত-চীন বাণিজ্য ঘাটতি ছিল প্রায় ৯ হাজার ৯১২ কোটি ডলার, যা এ বছর ১০ হাজার কোটি ডলারের সীমা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করছে নয়াদিল্লি।
ভারত এক টাকার পণ্য বিক্রি করলে চীন তার বিপরীতে ১০ টাকার পণ্য বিক্রি করে—এই অসামঞ্জস্য দীর্ঘদিনের। তবে গত পাঁচ বছরে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়েছে। ২০২০-২১ থেকে ২০২৪-২৫ অর্থবছর পর্যন্ত চীনে ভারতের রপ্তানি কমেছে ৩৩ শতাংশ, আর চীন থেকে আমদানি বেড়েছে ৭৪ শতাংশ। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র কিছু চীনা পণ্যের ওপর অতিরিক্ত কর আরোপ করলে ভারত সেই সুযোগে চীনে নিজেদের বাজার খোঁজার চেষ্টা করে এবং গলওয়ানের তিক্ত স্মৃতি ভুলে যায়। চীনও এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভারতে নিজেদের রপ্তানি আরও বাড়িয়ে নেয়।
দিল্লির গবেষণা প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল ট্রেড রিসার্চ ইনিশিয়েটিভের (জিটিআরআই) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের আটটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতের কাঁচামালের সিংহভাগই এখন চীন থেকে আসছে। এর মধ্যে ওষুধ তৈরির সক্রিয় উপাদানের (এপিআই) ৭০ শতাংশ, সৌর প্যানেলের কাঁচামাল, বৈদ্যুতিক গাড়ি ও মোবাইলের ব্যাটারি, সেমিকন্ডাক্টর এবং বিভিন্ন বিরল খনিজ অন্যতম। বেইজিং যদি কোনো কারণে এসব পণ্যের সরবরাহ বন্ধ করে দেয়, তবে ভারতের ওষুধ শিল্প থেকে শুরু করে সবুজ জ্বালানি প্রকল্প পর্যন্ত সবই মুখ থুবড়ে পড়বে।
২০২০ সালের গলওয়ান সংঘাতের পর ভারত চীনা পণ্যের ওপর কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপের পাশাপাশি টিকটকসহ বিভিন্ন অ্যাপ নিষিদ্ধ করে এবং আমদানির নিয়মকানুন কঠোর করে। এর ফলে দুই দেশের মোট বাণিজ্য কমে আট হাজার ৭০০ কোটি ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু পরবর্তী বছরগুলোতে তা দ্রুত বাড়তে শুরু করে। ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ১২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারে পৌঁছায়, যার মধ্যে চীনের রপ্তানির পরিমাণ ছিল ১১ হাজার ৩৪৫ কোটি ডলার।
জিটিআরআই আরও জানিয়েছে, সরকারের পিএলআই (উৎপাদন-ভিত্তিক প্রণোদনা) প্রকল্প স্থানীয় শিল্পকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে চালু হলেও তা পুরোপুরি সফল হয়নি। বরং কাঁচামাল ও উন্নত যন্ত্রাংশ আমদানির প্রবণতা কমেনি।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, ‘চীন থেকে কাঁচামাল অনেক সস্তায় পাওয়া যায়, যার কোনো বিকল্প দেশীয় শিল্প এখনো তৈরি করতে পারেনি। পিএলআই প্রকল্প চালু হলেও কাঁচামাল ও উন্নত যন্ত্রপাতির জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরতা কমেনি। ফলে রপ্তানি বাড়লেও ঘাটতি বাড়ছে। চলতি অর্থবছরের এপ্রিল থেকে আগস্ট পর্যন্ত ভারতের রপ্তানি চার শতাংশ বাড়লেও বাণিজ্য ঘাটতি বেড়েছে ১৫ শতাংশ, যা অন্য কোনো বাণিজ্য অংশীদারের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি।’
জিটিআরআই-এর প্রতিষ্ঠাতা অজয় শ্রীবাস্তব বলেন, ‘মোদি সরকারের নীতি হিতে বিপরীত হয়েছে। ‘আত্মনির্ভর ভারত’-এর জন্য দেশীয় উৎপাদন বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে, কিন্তু কাঁচামালের জন্য চীনের ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে।’
বিশ্লেষকদের একাংশ মনে করছেন, চীনা পণ্যের ওপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করলে কিছুটা সুফল পাওয়া যেতে পারে। যেমন, ইস্পাত আমদানিতে ৩০ শতাংশ শুল্ক বসানোর পর ভারতীয় বাজারে চীনা ইস্পাতের দাপট কমেছে। তবে ওষুধ বা বিরল খনিজের মতো খাতে এমন শুল্ক আরোপ করা হলে ভারতের শিল্পই বড় ক্ষতির মুখে পড়বে এবং দেশে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
চীনের বিকল্প হিসেবে ভারত এখন আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর দিকে নজর দিচ্ছে। একই সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের বাইরে নতুন রপ্তানি বাজার তৈরির চেষ্টাও চালাচ্ছে নয়াদিল্লি। তবে এসব উদ্যোগের ফল পেতে আরও সময় লাগবে।
রাজনৈতিক দূরত্ব এবং সীমান্ত সংঘাতের পরও বাস্তবতা হলো, চীনের সরবরাহ ছাড়া ভারতের গুরুত্বপূর্ণ শিল্প খাতগুলো টিকিয়ে রাখা কঠিন। এ কারণেই গলওয়ানের ক্ষত ভুলে নয়াদিল্লিকে চীনা পণ্যের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যা দুই দেশের বাণিজ্য ব্যবধানকে আরও প্রকট করে তুলছে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.