বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা: গাজায় অধিকাংশ রোগই শনাক্ত হচ্ছে না

নজরদারি ও ল্যাবরেটরি ব্যবস্থা প্রায় পুরোপুরি ভেঙে পড়ায় গাজায় ছড়িয়ে পড়া অধিকাংশ রোগই শনাক্ত করা যাচ্ছে না বলে সতর্ক করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সংস্থাটি নিশ্চিত করেছে যে, টিকার সঙ্গে অটিজমের কোনো সম্পর্ক নেই এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরে যাওয়ায় সংস্থাটি বড় ধরনের অর্থসংকটে পড়েছে। বৃহস্পতিবার জেনেভায় এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

ডব্লিউএইচও-এর মানবিক ও দুর্যোগ বিষয়ক ইউনিটের প্রধান তেরেসা জাকারিয়া গাজার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, উপত্যকাটির জীবনযাত্রার অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে তা বর্ণনা করার ভাষা নেই।

প্রতিরোধ, শনাক্তকরণ এবং চিকিৎসার সুযোগ অত্যন্ত সীমিত উল্লেখ করে তেরেসা জাকারিয়া বলেন, ‘সংকীর্ণ পরিবেশে রোগ ছড়িয়ে পড়ার মতো সব উপাদান সেখানে বিদ্যমান, যা ইঙ্গিত দিচ্ছে যে প্রাদুর্ভাব খুব দ্রুত এবং অনিয়ন্ত্রিতভাবে ছড়িয়ে পড়তে পারে।’

জেনেভায় অ্যাসোসিয়েশন অফ অ্যাক্রেডিটেড করেসপন্ডেন্টস অ্যাট দ্য ইউনাইটেড নেশনস (এসিএএনইউ)-এর মিডিয়া ব্রিফিংয়ে তিনি এসব কথা বলেন। তেরেসা জাকারিয়া আরও জানান, মানবিক সহায়তা পৌঁছানো এবং রোগ নির্ণয়ের সক্ষমতা এখন অত্যন্ত সীমিত, যার ফলে প্রাথমিক পর্যায়ে রোগ শনাক্ত করা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

তিনি বলেন, ‘এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আমরা সম্ভবত বর্তমানে ওই অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়া অধিকাংশ রোগই শনাক্ত করতে পারছি না, কারণ আমাদের সেই সক্ষমতা নেই।’

ল্যাবরেটরির অভাবে রোগের ধরন বা তীব্রতা পরিমাপ করা সম্ভব হচ্ছে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সেখানে ল্যাব নেই যা আমাদের বিভিন্ন প্যাথোজেন শনাক্ত করতে সহায়তা করবে।’

স্বাস্থ্য ব্যবস্থা পুনরুজ্জীবিত করতে এবং রোগ শনাক্তকরণে মানবিক সহায়তা সরবরাহের ওপর জোর দেন এই কর্মকর্তা।

টিকার সঙ্গে অটিজমের সম্পর্ক নেই

সংবাদ সম্মেলনে ডব্লিউএইচও-এর মহাপরিচালক টেডরস আধানম গেব্রিয়েসুস ১৫ বছর ধরে ৩১টি গবেষণার পর্যালোচনা থেকে প্রাপ্ত নতুন তথ্য তুলে ধরেন। তিনি জানান, গ্লোবাল অ্যাডভাইজরি কমিটি অন ভ্যাকসিন সেফটি নিশ্চিত করেছে যে, টিকার সঙ্গে অটিজমের কোনো কার্যকারণ সম্পর্ক নেই। অ্যালুমিনিয়াম বা থিওমারসালযুক্ত টিকার ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য।

টেডরস বলেন, ‘এটি এ ধরনের চতুর্থ পর্যালোচনা এবং সবগুলোর ফলাফল একই। টিকা অটিজমের কারণ নয়।’

টিকাকে মানব ইতিহাসের অন্যতম শক্তিশালী ও যুগান্তকারী আবিষ্কার হিসেবে অভিহিত করে তিনি বলেন, ‘অটিজম টিকার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নয়।’

তহবিল সংকট ও কর্মী ছাঁটাই

চলতি বছর বিশ্ব স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে নজিরবিহীন চাপের মুখে পড়তে হয়েছে বলে জানান টেডরস। তিনি উল্লেখ করেন, ২০২৫ সাল বিশ্ব স্বাস্থ্য এবং ডব্লিউএইচও-এর জন্য বড় চ্যালেঞ্জের বছর। উন্নয়ন সহায়তা কমে যাওয়ায় অনেক দেশে স্বাস্থ্যসেবা মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

শতাব্দীর শুরু থেকে এবারই প্রথম শিশুমৃত্যুর হার বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি। টেডরস জানান, উন্নয়ন সহায়তা কমে যাওয়া এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের ফলে আগামী দুই বছরের জন্য সংস্থাটি প্রায় ৫০ কোটি ডলারের বেতন ঘাটতির মুখে পড়েছে।

সংস্থাটির প্রধান মানবসম্পদ কর্মকর্তা প্যাট্রিক নিকোলিয়ার জানান, কর্মীদের ছাঁটাই থেকে রক্ষা করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হয়েছে। তবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় ও স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের মাধ্যমে প্রায় ১১০০ কর্মী চলে যাওয়ার পরেও তা যথেষ্ট ছিল না। ফলে পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আরও ১২৮০টি পদ ছাঁটাই করতে হয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ও সুদানের পরিস্থিতি

যুক্তরাষ্ট্র ও বিভিন্ন উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরিত হওয়া প্রসঙ্গে টেডরস বলেন, এ ধরনের চুক্তি ডব্লিউএইচও-এর ভূমিকাকে খর্ব করে না। তিনি বলেন, ‘এটি দুটি সার্বভৌম দেশের মধ্যকার বিষয় এবং এতে আমি দোষের কিছু দেখি না।’

তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, দ্বিপাক্ষিক চুক্তি কখনোই ১৯৪টি দেশকে নিয়ে গঠিত আন্তর্জাতিক কাঠামোর বিকল্প হতে পারে না। তিনি সতর্ক করে বলেন, ডব্লিউএইচও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সরে যাওয়া কোনো পক্ষের জন্যই লাভজনক নয়।

সুদানের পরিস্থিতি নিয়েও গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন টেডরস। তিনি জানান, সুদানের পরিস্থিতি অত্যন্ত হতাশাজনক এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিষয়টিতে যথাযথ গুরুত্ব দিচ্ছে না। দেশটিতে ১ কোটি ৪০ লাখের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে এবং ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু ও কলেরার প্রাদুর্ভাব বাড়ছে।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে বিশ্বে কলেরায় মৃত্যুর সংখ্যা সুদানেই সবচেয়ে বেশি।’

এই ট্র্যাজেডি মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানান তিনি।