যেভাবে বদলে গেল লাতিন আমেরিকার রাজনৈতিক মানচিত্র
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে ২০২৫ সালে এক বড় পরিবর্তন পরিলক্ষিত হয়েছে। নব্বই ও দুই হাজারের দশকের বামপন্থী আধিপত্যের বিপরীতে এ বছর চিলি, আর্জেন্টিনা ও ইকুয়েডরের মতো দেশগুলোতে ডানপন্থী শক্তির ব্যাপক উত্থান ঘটেছে। অপরাধ দমন ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এসব দেশের ক্ষমতায় এসেছেন রক্ষণশীল নেতারা, যা এই অঞ্চলের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য মোড় পরিবর্তন হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।

চলতি মাসের শুরুতে চিলির ভোটাররা কট্টর ডানপন্থী প্রার্থী হোসে আন্তোনিও কাস্তকে বিপুল ভোটে জয়ী করেছেন। তিন দশকেরও বেশি সময় আগে আগুস্তো পিনোচেতের সামরিক একনায়কতন্ত্র শেষ হওয়ার পর দেশটিতে এটি ডানপন্থীদের দিকে সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক ঝোঁক। নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হিসেবে প্রথম ভাষণে কাস্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় কঠোর হওয়ার ঘোষণা দেন। সমর্থকদের উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘চিলি আবারও অপরাধমুক্ত, যন্ত্রণামুক্ত এবং ভীতিমুক্ত হবে।’ তিনি অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং আইন লঙ্ঘনকারী অনিয়মিত অভিবাসীদের দেশ থেকে বের করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
লাতিন আমেরিকার রাজনীতিতে ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকে পড়ার এটি সর্বশেষ নিদর্শন। ২০২৫ সালে লাতিন আমেরিকার চারটি দেশে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সবকটিতেই বিজয়ী হয়েছেন রক্ষণশীল বা ডানপন্থী রাজনৈতিক শক্তির প্রার্থীরা। এপ্রিলে ইকুয়েডরে ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নোবোয়া দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতা সুসংহত করেন। অক্টোবরে বলিভিয়ায় মধ্য-ডানপন্থী সিনেটর রদ্রিগো পাজ পেরেইরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে রান-অফে জয়ী হন। এর মাধ্যমে দেশটিতে বামপন্থী ‘মুভিমিন্টো আল সোশ্যালিজম’ দলের কয়েক দশকের দীর্ঘ আধিপত্যের অবসান ঘটে।
একই মাসে আর্জেন্টিনার কট্টর ডানপন্থী প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই মধ্যবর্তী নির্বাচনে তার দলকে বিশাল জয় এনে দেন এবং দেশব্যাপী ৪০.৮ শতাংশ ভোট নিশ্চিত করেন। এছাড়া গত ৩০ নভেম্বর হন্ডুরাসেও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর কারিগরি ত্রুটি, ভোট গণনা ব্যবস্থায় নিরাপত্তা উদ্বেগ এবং ভোট জালিয়াতির অভিযোগের কারণে ফলাফল প্রকাশে কয়েক সপ্তাহ বিলম্ব হয়। দেশটির নির্বাচন কাউন্সিল ঘোষিত চূড়ান্ত ফলাফলে দেখা যায়, রক্ষণশীল প্রার্থী নাসরি আসফুরা ৪০.৩ শতাংশ ভোট পেয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন। যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনপুষ্ট আসফুরা মধ্য-ডানপন্থী প্রার্থী সালভাদর নাসরাল্লাকে সামান্য ব্যবধানে পরাজিত করেন এবং এই কঠিন জয়ের পর দেশ শাসনে প্রস্তুত বলে জানান।
বিশ্লেষকদের মতে, ডানপন্থী ও কট্টর ডানপন্থী রাজনীতির এই উত্থান ১৯৯০ ও ২০০০-এর দশকের ‘পিংক টাইড’ বা বামপন্থী জোয়ারের বিপরীত স্রোত। তখন লাতিন আমেরিকার অধিকাংশ দেশে বামপন্থী সরকার ক্ষমতায় ছিল। এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের প্রভাষক কনসুয়েলো থিয়ার্স আনাদোলু এজেন্সিকে বলেন, ‘এই প্রবণতা এখন বিপরীত দিকে মোড় নিচ্ছে এবং আর্জেন্টিনা ও চিলির মতো দেশগুলোতে কট্টর ডানপন্থীদের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে।’
বিশেষজ্ঞরা ক্রমাগত অপরাধ, অর্থনৈতিক অস্থিরতা, বেকারত্ব এবং দুর্নীতির কারণে ভোটারদের হতাশাকে এই পরিবর্তনের মূল চালিকাশক্তি হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। থিয়ার্স বলেন, ‘কট্টর ডানপন্থী নেতারা মূলত একই ধরনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। বিশেষ করে আর্জেন্টিনার মতো তীব্র সংকটে থাকা অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং সংগঠিত অপরাধের বিস্তার রোধে নিরাপত্তা জোরদারের কথা তারা বলছেন।’ তিনি আরও উল্লেখ করেন যে, জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তাহীনতার কারণে ভোটারদের মধ্যে এই বার্তাটি জোরালো প্রভাব ফেলেছে।
লাতিন আমেরিকার নবনির্বাচিত অনেক ডানপন্থী নেতা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের জোরালো সমর্থন পাচ্ছেন। ট্রাম্প প্রকাশ্যে আর্জেন্টিনা ও হন্ডুরাসের মতো দেশগুলোর ভোটারদের তার পছন্দের প্রার্থীদের সমর্থন করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের ‘ইনস্টিটিউট অব দ্য আমেরিকাস’-এর লাতিন আমেরিকার ইতিহাসের প্রভাষক উইলিয়াম এ. বুথ ট্রাম্পকে কট্টর ডানপন্থী নেতাদের বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে মূল প্রভাবক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, ‘মিলেই, কাস্ত এবং বলসোনারোর মতো নেতাদের বৈধতা দেওয়ার ক্ষেত্রে ট্রাম্প একটি বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। অন্য পরিস্থিতিতে হয়তো তাদের অযৌক্তিক ষড়যন্ত্রকারী ধর্মান্ধ হিসেবে বাতিল করে দেওয়া হতো।’
তবে কনসুয়েলো থিয়ার্স উল্লেখ করেন যে, অনেক লাতিন আমেরিকান সরকার ওয়াশিংটন ও বেইজিংয়ের মধ্যে সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতি দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দূরত্বের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। সম্প্রতি বেশ কয়েকটি সরকার হেজিং কৌশল বা ভারসাম্য বজায় রাখার নীতি গ্রহণ করেছে, যার লক্ষ্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের সঙ্গে সম্পর্ক রাখা।’ চিলি ও পেরুর মতো দেশগুলোর জন্য চীন একটি প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার হয়ে উঠেছে, যা তাদের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বহুমুখী করতে সহায়তা করেছে।
২০২৬ সালে ব্রাজিল, কলম্বিয়া, কোস্টারিকা, হাইতি এবং পেরুতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে। বিশ্লেষকরা ভবিষ্যদ্বাণী করছেন যে, দেশগুলোতে মেরুকরণ অব্যাহত থাকবে। উইলিয়াম এ. বুথ বলেন, ‘লাতিন আমেরিকা এই মুহূর্তে ঠিক মাঝখান দিয়ে বিভক্ত। ইকুয়েডর থেকে আর্জেন্টিনা পর্যন্ত ডানপন্থী সরকারগুলোর একটি অবিচ্ছিন্ন রেখা রয়েছে, অন্যদিকে কলম্বিয়া, ভেনিজুয়েলা, ব্রাজিল এবং উরুগুয়ে রয়েছে বিভাজনের অপর পাশে।’
বুথ মনে করেন, ব্রাজিলের বামপন্থী প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা সুবিধাজনক অবস্থানে থাকলেও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের আশঙ্কা রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ট্রাম্প নিঃসন্দেহে লুলার বিরুদ্ধে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করবেন, তবে তার গতবারের হস্তক্ষেপটি বেশ দর্শনীয়ভাবে বুমেরাং হয়েছিল।’ পেরুর বামপন্থী শক্তি রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দুর্বল হয়ে পড়েছে, যা ডানপন্থী প্রার্থীদের আধিপত্য বিস্তারের সুযোগ করে দিয়েছে। হাইতি প্রসঙ্গে বুথ বলেন, ‘হাইতিতে কী ঘটবে তা বলা কঠিন। কারণ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আবারও সেখানে একটি সরকার চাপিয়ে দিয়েছে, যা কয়েক দশক ধরে চলা ধ্বংসাত্মক হস্তক্ষেপের সাধারণ ধারারই অংশ।’
আনাদোলু এজেন্সি অবলম্বনে
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.