দায় দুদককে নিতেই হবে, জাহালম ইস্যুতে হাইকোর্ট

সোনালী ব্যাংকের ১৮ কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির মামলায় টাঙ্গাইলের জাহালমকে ভুলভাবে জড়ানোর বিষয়টি নজরে আসার পরপরই দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষ থেকে তার জামিনের ব্যবস্থা করা উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেছে হাইকোর্ট।

দুদকের আইনজীবীকে উদ্দেশ করে হাইকোর্ট বলেছে, ‘যখন বুঝলেন ভুলভাবে জাহালমকে মামলায় অন্তর্ভুক্ত করেছেন, তখন সাথে সাথেই কমিশনের উচিত ছিলো অন্তত তার জামিনের ব্যবস্থা করা। আপনাদের আইনজীবীরা তা করেনি। সে বার বার আদালতে বলেছে, আমি সালেক না জাহালম। বার বার বলার পরও কেন আপনাদের প্রসিকিউশন তার জামিনের ব্যবস্থা করলো না? এর দায় আপনাদের নিতে হবে।’

বিনা অপরাধে তিন বাছর কারাভোগকারী জাহালমের ঘটনার বিস্তারিত বর্ণনার হলফনামা (এফিডেভিট) দাখিলের পর বুধবার বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসান ও বিচারপতি কে এম কামরুল কাদেরের বেঞ্চ এ মন্তব্য করেন।

আদালত বলে, ‘অনেকগুলো বিষয়ের ব্যাখ্যা দরকার। এ ঘটনায় ১৮টি ব্যাংক জড়িত। প্রত্যেকটি ব্যাংকে মামলায় পক্ষভুক্ত করবেন। ইসলামী ব্যাংক ১৩টি চেক ইস্যু করেছে। ব্যাংকের কতজন অফিসারের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দিয়েছেন? যাকে আসামি করা উচিত ছিল, তাকে আসামি না করে আপনারা সাক্ষী বানিয়েছেন। দেশে যেখানে অর্থনীতির সক্ষমতা বাড়ছে সেখানে সিন্ডিকেট করে সব নিয়ে যাচ্ছে। এটা দেখা দরকার। সবগুলো মামলার অভিযোগপত্র দেবেন। ৩৩ মামলার সব নথিপত্র দেবেন। আমরা সব দেখবো।’

পরে এ ঋণ জালিয়াতির ঘটনায় করা ৩৩টি মামলার এফ আই আর ও এর মধ্যে ২৬টি মামলার অভিযোগপত্রসহ যাবতীয় নথিপত্র দাখিলের জন্য দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান প্রথমে ৬ সপ্তাহ ও পরে ৪ সপ্তাহ সময় আবেদন করেন। আদালত এসব দাখিলের জন্য আগামী ১০ এপ্রিল পর্যন্ত সময় দিয়ে ওইদিন এবিষয়ে পরবর্তী শুনানির তারিখ ধার্য করেন।

বুধবার খুরশীদ আলম শুনানিতে সোনালী ব্যাংকের ঋণ জালিয়াতির মামলায় জাহালমকে কীভাবে ২৬ মামলার আসামি করা হয়, আবার দুদকের অধিকতর তদন্তে জাহালম কীভাবে নির্দোষ প্রমাণিত হলেন-এসব ব্যাপারে হলফনামা দাখিল করেন। পরে হলফনামা থেকে আদালতকে পড়ে শোনানো শুরু করেন।

দুদক আইনজীবী আদালতকে জানান, ব্যাংক কর্মকর্তাসহ সাক্ষীরা টাঙ্গাইলের জাহালমকে সালেক বলে শনাক্ত করেন। তবে অধিকতর তদন্তে জানা যায়, প্রকৃত আসামি সালেকের বাড়ি ঠাকুরগাঁও।

তিনি বলেন, ‘চ্যানেল-২৪ এ জাহালমের বিষয়ে রিপোর্ট আসার পর জাহালম যে নির্দোষ সে বিষয়ে দুদক অধিকতর তদন্তের জন্য তদন্ত কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়। সে তদন্তে জাহালম যে নির্দোষ তা উঠে আসে। পরে অধিকতর তদন্ত প্রতিবেদন বিচারিক আদালতে জমা দেয়া হয়। একই সঙ্গে জাহালমের বিরুদ্ধে থাকা অভিযোগ প্রত্যাহার চেয়েও বিচারিক আদালতে আবেদন করা হয়। তাই আমরা তো বিষয়টি নিয়ে সঠিক পথেই আছি।’

তখন আদালত বলে, ‘চ্যানেল ২৪ এ রিপোর্ট হওয়ার আগে তিনি (তদন্ত কর্মকর্তা) কি করেছেন? দুদককে স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। সুপারিশের মধ্যে না থেকে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। দুদক একটা জাতীয় প্রতিষ্ঠান। দুদক সম্পর্কে নেতিবাচক ধারণা হোক, তা আমরা চাই না। কিন্তু যে বিড়াল ইঁদুর ধরতে পারে না তা রেখে লাভ কি? বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতি হচ্ছে। আগে দুর্নীতিবাজদের মানুষ ঘৃণা করত। এখন আমাদের নৈতিক অধঃপতন হয়েছে।’

এ সময় খুরশীদ ্অলম খান বলেন, আমরা স্বাধীন প্রতিষ্ঠান কিন্তু কিছু সিডিউল দিয়ে আমাদের হাত-পা বেঁধে দেওয়া হয়েছে। সিডিউলের ভেতরে থেকেই আমাদের কাজ করতে হয়। আদালত বলেন, যতটুকু স্বাধীনতা আছে সেটুকু করলেই তো হয়। স্বাধীনতা পাবেন আর কাজ করবেন না-এটা তো হতে পারে না।

এ সময় আদালত খুরশীদ আলমের কাছে জানতে চায়, ‘কবে আপনারা জানলেন জাহালম নির্দোষ?’ খুরশীদ আলম খান জানান, গত বছরের ২৭ ফেব্রুয়ারি চ্যানেল-২৪-এ রিপোর্টের পর। আদালত বলে, কবে চিহ্নিত করেছেন যে সে নির্দোষ, তা এখানে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করেননি।

খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে উল্লেখ করতে পারিনি। ২৬টি মামলার চার্জশিটসহ সবই দিয়ে দেব। আমাদের সময় দিন।’

আদালত তখন দুদকের এই আইনজীবীর উদ্দেশে বলে, ‘যখন আপনারা জানতে পারলেন জাহালম নির্দোষ, তখন আপনাদের উচিত ছিল জাহালমের জামিনের ব্যবস্থা করা। জাহালম বলে আসছেন, তিনি নির্দোষ। প্রসিকিউশন জানলেন কিন্তু কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এর দায় আপনাদের নিতেই হবে।’

এসময় দুদক আইনজীবী বলেন, পাঁচটি ব্যাংকে (বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, সিটি ব্যাংক লিমিটেড, ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক) পক্ষভুক্ত করে নিন।’

তখন আদালত বলে, ‘আপনারা পিক এন্ড চ্যুজ করছেন। ১৮টি ব্যাংকের নাম এসেছে। সবগুলোকেই পক্ষভুক্ত করতে হবে।’ জবাবে দুদক আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘কোর্ট চাইলে আমরা সকলকে (১৮টি ব্যাংক) পক্ষভুক্ত করে নিবো।‘ পরে আদালত সোনালী ব্যাংক আগেই পক্ষভুক্ত থাকায় বাকি চারটি ব্যাংকে পক্ষভুক্ত করার আবেদন মঞ্জুর করে। এছাড়া পরবর্তী শুনানির জন্য ১০ এপ্রিল দিন ধার্য করেন।

জানা যায়, সোনালী ব্যাংকের প্রায় সাড়ে ১৮ কোটি টাকা জালিয়াতির অভিযোগে আবু সালেক নামের এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ৩৩টি মামলা করে দুদক। কিন্তু দুদকের ভুলে সালেকের বদলে তিন বছর ধরে কারাগারে কাটাতে হয়েছে টাঙ্গাইলের জাহালমকে।

এ নিয়ে গত ৩০ জানুয়ারি একটি জাতীয় দৈনিকে ‘স্যার, আমি জাহালম, সালেক না’ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনটি সেদিন বিচারপতি এফ আর এম নাজমুল আহসানের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চের নজরে আনেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অমিত দাশ গুপ্ত। পরে আদালত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে রুল জারি করে। সব পক্ষের বক্তব্য শুনে গত ৩ ফেব্রুয়ারি নিরপরাধ পাটকল শ্রমিক জাহালমকে অর্থ জালিয়াতির মামলা থেকে অব্যাহতি দিয়ে ওইদিনই মুক্তির নির্দেশ দেয় হাইকোর্ট। সে অনুযায়ী সেদিন তিনি মুক্তিও পান। একই সঙ্গে এই ঘটনার বিস্তারিত প্রতিবেদন হলফনামা আকারে দুদককে দাখিলের নির্দেশ দিয়ে ৬ মার্চ পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করে।