বিলাসবহুল সরকারি ফ্ল্যাটে চমকপ্রদ ‘দুর্নীতি’

একটি বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা! আর সেই বালিশ নিচ থেকে ফ্ল্যাটে উঠাতে খরচ ৭৬০ টাকা! আমাদের সমাজে একটি প্রবাদ প্রচলিত আছে- 'মশা মারতে কামান দাগা'।অর্থাৎ সামান্য কাজের জন্য বিশাল আয়োজন। এমন ঘটনাই ঘটেছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পে। ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ এসেছে গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য নির্মিত ভবনের আসবাবপত্র কেনা ও ফ্ল্যাটে তোলার ক্ষেত্রে। নথিপত্র ঘেঁটে এমন তথ্যই উঠে এসেছে বলে খবর প্রকাশ করেছে সংবাদ মাধ্যম দেশ রূপান্তর।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের জন্য ৩৩০টি বালিশ ক্রয় করতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ ৬৫ হাজার ৮১০ টাকা। আর উপরে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ২ লাখ ৫০ হাজার ৮০০ টাকা। শুধু তাই নয়, অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে ফ্ল্যাটের অন্যান্য সব আসবাবপত্র কেনা ও সেগুলো ভবনে উঠানোর ক্ষেত্রেও। এই অস্বাভাবিক ব্যয়ের ঘটনা ঘটিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তরের পাবনা পূর্ত বিভাগের কর্মকর্তারা।

শুধু বালিশ নয়, বালিশসহ অন্তত ৫০টি পণ্য উপরে উঠাতে ক্রয়মূল্যের প্রায় অর্ধেক খরচ দেখানো হয়, কোনো কোনো ক্ষেত্রে সেটি ৭৫ শতাংশেরও বেশি।

সংশ্লিষ্টরা জানান, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি সরকারের অগ্রাধিকার তালিকায় রয়েছে। এই প্রকল্পের আওতায় মূল প্রকল্প এলাকার বাইরে তৈরি করা হচ্ছে গ্রিনসিটি আবাসন পল্লী। সেখানে ২০ তলা ১১টি এবং ১৬ তলা আটটি ভবন তৈরি করা হচ্ছে এই বিদ্যুৎকেন্দ্রে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীদের থাকার জন্য। ইতোমধ্যে ২০ তলা আটটি এবং ১৬ তলা একটি ভবন তৈরির কাজ শেষ হয়েছে। এমনকি নির্মাণ কাজ শেষ হওয়া নয়টি ভবনের ৯৯৬টি ফ্ল্যাটের জন্য আসবাবপত্রও কেনা শেষ হয়েছে। এর মধ্যে ২৫ কোটি ৬৯ লাখ ৯২ হাজার ২৯২ টাকা খরচ দেখানো হয়েছে ২০ তলা ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের আসবাবপত্র কেনা ও তা ভবনে উঠানো বাবদ।

শুধু বালিশের ক্ষেত্রেই নয়, এ রকম অস্বাভাবিক ব্যয় দেখানে হয়েছে বিছানার চাদর কেনার ক্ষেত্রেও। প্রতিটি বিছানার চাদর ৫ হাজার ৯৮৬ টাকা করে ৩০০টি চাদর কিনতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৯ লাখ ৭৫ হাজার ৩৮০ টাকা। আর উপরে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৩ লক্ষ ৭২ হাজার ২৩০টাকা।

এ ছাড়া ১ লাখ ৩৬ হাজার ১১২ টাকা দরে ১১০টি ওয়াশিং মেশিন কিনতে খরচ করা হয়েছে মোট ১ কোটি ৪৯ লাখ ৭২ হাজার ৩২০ টাকা। আর সেগুলো ফ্ল্যাটে নেওয়ার খরচ দেখানো হয়েছে প্রতিটি ৩০ হাজার ৪১৯ টাকা করে মোট ৩৩ লাখ ৪৬ হাজার ৯০ টাকা। ১১০টি টেলিভিশনের প্রত্যেকটি কেনা হয়েছে ৮৬ হাজার ৯৬০ টাকায়। টেলিভিশন কিনতে সর্বমোট ব্যয় হয় ৯৫ লাখ ৬৫ হাজার ৬০০ টাকা এবং নিচ থেকে উপরে উঠাতে খরচ হয় ৮৪ লাখ ১৮০ টাকা। আর সেগুলো রাখার জন্য টেলিভিশন কেবিনেট কেনা হয়েছে ৫২ হাজার ৩৭৮ টাকা করে। আর ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা দরে কেনা প্রতিটি রেফ্রিজারেটর উপরে উঠাতে ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ৫২১ টাকা করে। 

গণমাধ্যমটি দাবি করছে, প্রকল্পের নথিপত্র পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০ তলা এই ভবনের ১১০টি ফ্ল্যাটের প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের জন্য ৯৪ হাজার ২৫০ টাকা দরে ফ্রিজ কিনতে খরচ হয়েছে ১ কোটি ৩৬ লাখ ৭ হাজার ৫০০ টাকা। আর এই ১১০টি ফ্রিজ সংশ্লিষ্ট ফ্ল্যাটে নিতে খরচ হয় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার ৩১০ টাকা।

৫ হাজার ৩১৩ টাকা দরে প্রতিটি ইলেকট্রিক কেটলি কিনে ভবনে উঠানো বাবদ খরচ দেখানো হয়েছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। এ ছাড়াও প্রতিটি ইলেক্ট্রিক আয়রন কেনা হয়েছে ৪ হাজার ১৫৪ টাকায়, আর উপরে তুলতে লেগেছে ২ হাজার ৯৪৫ টাকা। একেকটি চুলা কিনতে লেগেছে ৭ হাজার ৭৪৭ টাকা, ফ্ল্যাটে তুলতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা।

৪৩ হাজার ৩৫৭ টাকা দরে প্রত্যেকটি ফ্ল্যাটের জন্য খাট কিনতে খরচ হয়েছে ৪৭ লাখ ৬৯ হাজার ২৭০ টাকা। সবগুলো খাট ফ্ল্যাটে পৌঁঁছাতে মোট খরচ হয় ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৩০ টাকা। এ ছাড়া রুম পরিষ্কার করার প্রত্যেকটি মেশিনের ব্যয় দেখানো হয়েছে ১২ হাজার ১৮ টাকা, ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৬৫০ টাকা করে। 

অন্যদিকে, ৫৯ হাজার ৮৫৮ টাকা দরে ১১০টি ওয়ারড্রব কিনতে খরচ করা হয়েছে ৬৫ লাখ ৮৪ হাজার ৩৮০ টাকা, আর ভবনে উঠাতে খরচ দেখানো হয়েছে ১৭ লাখ ৪৯ হাজার ৯০০ টাকা। ৩৬ হাজার ৫৭ টাকা দরে ৩৩০টি ম্যাট্রেস ও তোশক কেনা হয়েছে মোট ১ কোটি ২০ লাখ ৬ হাজার ৮১০ টাকায়। আর এসব ভবনে উঠাতে খরচ করা হয়েছে ২৫ লাখ ৫৮ হাজার ১৬০ টাকা।

এ সম্পর্কে প্রকল্পের দায়িত্বে থাকা পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মাসুদুর রহমান বলেন, ‘গণপূর্ত অধিদপ্তরের বিধিমালা মেনেই আমরা কাজ করে থাকি। মালামাল কেনাসহ অন্যান্য কাজ উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই করা হয়েছে। কোনো ধরনের অনিয়মের সুযোগ নেই এখানে। যাচাই-বাছাই করেই সব কিছু করা হয়েছে।’

গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘এসব কাজ আমি দায়িত্ব নেয়ার আগেই শেষ হয়েছে। তাই খোঁজ-খবর নেয়া ছাড়া কিছু বলা যাচ্ছে না। যদি কোনো অনিয়ম হয়ে থাকে সেটি তদন্ত করে দেখা হবে।’