ঈদযাত্রায় ‘ভাই পার্টি’ হতে সাবধান

ঈদ আসলেই নাড়ির টানে গ্রামের বাড়িতে ছুটে যান রাজধানীবাসী। স্বজনদের সঙ্গে ঈদ আনন্দকে ভাগাভাগি করে নিতে ভিড় জমান নগরীর বিমানবন্দর, রেলস্টেশন, বাস ও লঞ্চ টার্মিনালগুলোতে। ঘরমুখো যাত্রীদের পাশাপাশি এ সময় সক্রিয় হয়ে ওঠে বিভিন্ন প্রতারক চক্র। যারা যাত্রীদের ফাঁদে ফেলে লুট করে নেয় সর্বস্ব। গোয়েন্দারা বলছেন, এবার ঈদে মাঠে নেমেছে ‘ভাই পার্টি’।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বলছে, আসন্ন ঈদুল আযহাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে এবার সক্রিয় হয়ে উঠেছে 'ভাই পার্টি'র ১০টি গ্রুপ। এসব গ্রুপে সদস্যও রয়েছে অর্ধশতাধিক। বিভিন্ন জনবহুল এলাকাগুলোতে প্রতারক চক্রের এসব সদস্যরা অভিনব কৌশলে সর্বনাশ করছে টার্গেট করা ব্যক্তিদের। বন্ধু বা স্বজন সেজে লুট করে নিচ্ছে যাত্রীদের সবকিছু। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, অজ্ঞান পার্টির লেটেস্ট ভার্সনই এই 'ভাই পার্টি'।

রাজধানীর বিভিন্ন হাসপাল সূত্রে জানা যায়, গত এক সপ্তাহে এই ভাই পার্টির হাতে সর্বস্ব হারিয়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতাল ও স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল হাসপাতালসহ নগরীরর বিভিন্ন সরকারি বেসকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছেন শতাধিক মানুষ। শুধু ঢামেকেই প্রতিদিন চিকিৎসা নিচ্ছেন তিন থেকে পাঁচ জন। হাসপাতালের রেজিস্টারে এসব রোগীর ভর্তির কারণ হিসেবে লেখা থাকে 'আননোন পয়জনিং'। সম্প্রতি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু রোগী বেশী থাকায় বিষয়টি তেমন কারোর নজরে আসেনি।

জানা যায়, প্রতারক চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন টার্মিনাল ও রেলস্টেশনগুলোতে প্রথমে যাত্রীদের টার্গেট করে। তারপর ভাব জমায় তাদের সঙ্গে। কৌশলে সখ্য গড়ে তোলার পর অপেক্ষায় থাকে সুযোগের। তারপর সময়মতো অচেতন করে লুট করে নেয় টার্গেট করা যাত্রীর সবকিছু। ফলে যাত্রীরা ঈদে পথ চেয়ে থাকা পরিবারের লোকজনের হাতে কষ্ট করে উপার্জিত অর্থ তুলে দেয়ার আগেই খুঁইয়ে ফেলেন সবকিছু।

নাম-পরিচয় প্রকাশে অনিচ্ছুক ভাই পার্টির এক সদস্য জানান, তিনি প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে এমন প্রতারণার সঙ্গে যুক্ত। প্রথম দিকে তারা যে কৌশলে অচেতন করে মানুষের টাকা-পয়সা লুট করতো এখন আর সেই কৌশল ব্যবহার করে না। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তাদেরও কৌশল পরিবর্তন করতে হয়।

প্রতারণার বর্তমান কৌশল সম্পর্কে তিনি বলেন, দলে কাজ করা প্রত্যেকে বিভিন্ন জায়গায় টার্গেট খুঁজতে থাকে এবং নিয়মমতো প্রতি ১০ মিনিট পরপর একজন আরেকজনকে ফোন দিয়ে খোঁজ খবর নেয়। টার্গেটের সাংকেতিক নাম হিসেবে তারা 'ভাই' সম্বোধন ব্যবহার করে। কাউকে ফোন দেওয়ার যদি অপর প্রান্ত থেকে উত্তর আসে যে, 'ভাইয়ের কাছে আছি', তাহলে বুঝতে হবে শিকার ধরা হয়েছে। তখন দলের অন্যান্য সদস্যরা সেই জায়গায় ছুটে যায়। এ সময় প্রতারক চক্রের কেউ কেউ এসে পরিচিত হয়, কেউবা দূরে দাঁড়িয়ে থেকে টার্গেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। ভাই সম্বোধনকারী প্রতারক কখনো কখনো নিজেকে টার্গেটের এলাকার লোক হিসেবে মিথ্যা পরিচয় দেয় এবং দলের অন্যান্য সদস্যদেরও আত্মীয় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়। এভাবে কৌশলে সহজ সরল মানুষের সঙ্গে ভাব জমায় প্রতারকরা।

এভাবে টার্গেটের সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে একজন উঠে গিয়ে জুস, ঝালমুড়ি, চানাচুর, কোল্ড ড্রিংস, চা বা কফি নিয়ে আসে। প্রতারক চক্রের লোকজন টার্গেটের সামনেই কোল্ড ড্রিংসের মুখ খুলে পানীয় খেতে থাকে যাতে করে টার্গেটের মনে কোন ধরনের সন্দেহ সৃষ্টি না হয়। এ সময় অন্য একজন কথা বলার ছলে টার্গেটের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। সুযোগ বুঝে চক্রের প্রথমজন কৌশলে আঙ্গুলের ফাঁকে থাকা ওষুধের গুঁড়া ড্রিংসের ভেতর দিয়ে দেয়। এরপর টার্গেটকে সেটি খেতে দিলে তিনি কোন ধরনের সন্দেহ ও আপত্তি করেন না। কারণ তার সামনেই অন্যরা সেটি খেয়েছে। সেই ড্রিংস খাওয়া কিছুক্ষণ পরেই অচেতন হয়ে পড়েন ভিকটিম। এরপর তার সর্বস্ব লুট করে সেখান থেকে সটকে পড়েন প্রতারকরা।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ঢাকা উত্তর ভিভাগের ইন্সপেক্টর জুয়েল মিয়া জানান, রাজধানীতে ভাই পার্টির ১০টির বেশি চক্র সক্রিয় রয়েছে। এদের প্রত্যেক দলেই রয়েছে ৫ থেকে ৬ জন সদস্য। এরা খুবই চতুর। সম্প্রতি বিমানবন্দর এলাকা থেকে এই চক্রের এক সদস্যকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে পিআইবিকে বেশ কয়েকটি কৌশলের কথা জানিয়েছে সে।

তিনি আরও জানান, এই প্রতারক চক্রটি এমন একটি মেডিসিন ব্যবহার করে যা জুস বা কোল্ড ড্রিংসের সঙ্গে দ্রুত মিশে যায় এবং ভিকটিমকে খাওয়ানোর সঙ্গে সঙ্গেই সে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। তবে এ সময় সবকিছু দেখতে পারে, কিন্তু চিৎকার করতে পারে না। তার সবকিছু নিয়ে যাচ্ছে দেখেও বাধা দিতে পারে না।

জুয়েল মিয়া আরও জানান, ভাই পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন বাসস্ট্যান্ড ও রেলস্টেশনে ঘোরাফেরা করে। সিঙ্গেল যাত্রী দেখলেই টার্গেট করে। ওই যাত্রী যে অঞ্চলে যাবে প্রতারক চক্রের সদস্য নিজেকেও ওই অঞ্চলের যাত্রী বলে পরিচয় দিবে এবং একই বাসে পাশাপাশি টিকিট কেটে বসবে। এরই মধ্যে চক্রের অন্যান্য সদস্যরাও টিকিট কেটে ওই বাসে উঠে পড়ে। পরে পথে সুবিধামতো জায়গায় ওই যাত্রীকে ওষুধ মিশানো খাবার খাইয়ে সর্বস্ব লুট করে নেমে যাবে।

পিবিআই ঢাকা মেট্রো উত্তর বিভাগের বিশেষ পুলিশ সুপার আবুল কালাম আজাদ বলেন, অজ্ঞান পার্টির লেটেস্ট ভার্সনই এই ভাই পার্টি। নতুন এই প্রতারক চক্রের সদস্যদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। তবে এদের হাত থেকে মুক্ত থাকতে জনগণকে সচেতন হতে হবে। ভ্রমণকালে অপরিচিত কারোর দেয়া খাবার না খাওয়ার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানান তিনি।