বাগেরহাটে চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়
- Details
- by নিজস্ব প্রতিবেদক
বাগেরহাটে ভাইরাসের কারণে সাদা সোনাখ্যাত বাগদা চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। অধিকাংশ ঘেরের চিংড়ি ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মরে উজাড় হয়ে গেছে। এর প্রভাবে বাজারে চিংড়ির দাম অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে।
ভাইরাসের কারণে বাগেরহাটে চিংড়ি শিল্পে বিপর্যয়
উৎপাদন খরচের চেয়ে কম মূল্যে বিক্রি করার কারণে আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়েছে বাগদার চিংড়ি শিল্প। গত বছরের তুলনায় এ বছর হাট-বাজারে প্রতিকেজি বাগদা চিংড়ির দাম তিন থেকে চারশত টাকা কমে গেছে। একের পর এক লোকসানের কারণে চাষিরা চিংড়ি চাষে আগ্রহ হারাচ্ছে।
বাগেরহাট সদর উপজেলার বারাকাপুর পাইকারি মৎস্য আড়ত ঘুরে দেখা গেছে, বাগদার ভরা মৌসুম হলেও তুলনামূলকভাবে আমদানি কম। আর বাগদার আকার বিগত বছরের তুলনায় ছোট। গলদার মূল্য স্বাভাবিক থাকলেও বাগদার মূল্য কম। আকার অনুসারে প্রতি কেজি বাগদা ৬০০ থেকে ৭৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। বাগেরহাট জেলার ফকিরহাটের ফলতিতা এবং রামপাল উপজেলার ফয়লা বাজারের পাইকারি মৎস্য আড়তে বাগদা বিক্রির একই চিত্র।
জানা গেছে, বাগেরহাট, খুলনা সাতক্ষীরা এবং কক্সবাজারে চিংড়ি বেশি চাষ হয়। এর মধ্যে বাগেরহাটে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক ঘেরে বাগদা এবং গলদা চিংড়ির চাষ করা হয়। ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এ বছর বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় অধিকাংশ ঘেরে বাগদা চিংড়ি মারা গেছে। অনেক ঘেরে এখন জাল ফেললেও বাগদা মিলছে না। গত বছর যে পরিমাণ হিমায়িত খ্যাদ্য রাপ্তানি করা হয়েছে তার শতকরা ৭০ ভাগ বাগদা চিংড়ি বলে জানা গেছে।
হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারকরা বলছেন, বহির্বিশ্বে বাগদা চিংড়ি রপ্তানি করতে নতুন নুতন বাজার খুজতে হবে। একই সঙ্গে বিদেশিদের আগ্রহ বাড়াতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাগদা চিংড়ির প্রদর্শনী করলে সুফল পাওয়া যাবে।
চিংড়ি চাষি এবং বাগেরহাট সদরের বারাকপুর মৎস্য আড়তের ব্যবসায়ী আশ্বাদ আলী জানান, ১৫০ বিঘা জমিতে তার ৩৫টি মৎস্যঘের রয়েছে। ওই ঘেরগুলোতে মাঘ-ফাল্গুন মাসে বাগদা চিংড়ির পোনা ছাড়া হয়। তিনমাস পরে ওই বাগদা বিক্রির উপযোগী হওয়ার কথা। কিন্তু এ বছর চৈত্র এবং বৈশাখ মাসে হঠাৎ করে ঘেরে ভাইরাস দেখা দেয়। ভাইরাস শুরু হওয়ার তিন থেকে চার দিনের মধ্যে ঘেরের অধিকাংশ বাগদা মরে সাবার হয়ে গেছে।
তিনি আরও জানান, গেল বছর এই সময়ে যে বাগদা চিংড়ি ১০০০ থেকে ১১০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হয়েছে এখন তার মূল্য প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। এক বিঘা জমিতে বাগদা চাষ করতে গড়ে খরচ হয় ৪০ থেকে ৪৫ হাজার টাকা। আর বিক্রি হচ্ছে মাত্র ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা। এভাবে লোকসান গুনতে হলে তাদেরকে বাধ্য হয়ে চিংড়ি চাষ বন্ধ করতে হবে। চিংড়ি চাষ ধরে রাখতে সরকারের সহযোগিতার কথা জানালেন ওই চাষি।
বাগেরহাট সদর উপজেলার সুন্দরঘোনা গ্রামের মো. চঞ্চল শেখ জানান, ছয় থেকে সাত লাখ টাকা ধার দেনা করে খুব আশা করে এবছর ১০ বিঘা জমিতে চিংড়ি ঘের করেছি। কিন্তু ভাইরাস লেগে ঘেরের সব চিংড়ি মারা গেছে। এখন পর্যন্ত একটা চিংড়িও বিক্রি করতে পারিনি।
বাদোখালী গ্রামের নাসির শেখ জানালেন, আমি ২০ বছর ধরে চিংড়ি চাষ করছি। আগে চিংড়ি চাষ করে লাভবান ছিলাম। কিন্তু এখন চিংড়ি চাষ করে লোকসান হচ্ছে। ভাইরাসমুক্ত বাগদা চাষ এবং আন্তজার্তিক বাজারে যাতে মূল্য বেশি পাওয়া যায় সেজন্য সরকারের হস্তক্ষেপ চান ওই চাষি।
বাগেরহাট জেলা চিংড়ি চাষি সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন জানান, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির প্রভাব পড়েছে চিংড়ি চাষে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বিভিন্ন এলাকায় ভাইরাস লেগে ঘেরে বাগদা মারা গেছে। চিংড়ি শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে হলে চিংড়ি চাষে প্রণোদনা দিতে হবে। সহজ শর্তে ঋণসহ চিংড়ি চাষকে বিমার আওতায় আনতে হবে।
বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা ড. মো. খালেদ কনক জানান, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে সময়মতো বৃষ্টিপাত না হওয়া, তাপমাত্রা এবং লবণাক্ততা বেড়ে যাওযায় কারণে কিছু চিংড়ি মারা যাচ্ছে।
তিনি আরও জানান, চিংড়ির পোনা বা রেনু ছাড়ার পর সময় মতো খাবার না দেওয়া এবং ঠিকমতো পরিচর্যা না করার কারণে উৎপাদনের ক্ষেত্রে প্রভাব পড়ে। এছাড়া নির্ধারিত ঘনত্বের চেয়ে অধিক পরিমাণ চিংড়ি চাষ করার ক্ষেত্রেও আকার ছোট এবং উৎপাদন কম হয়। সনাতন পদ্ধতিতে চাষ করায় বর্তমানে বাগেরহাটে প্রতি হেক্টর জমিতে ৩০০ কেজি চিংড়ি উৎপাদন হচ্ছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করলে উৎপাদন হবে ১০০০ কেজি। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষ করা হলে চিংড়ি চাষ লাভজন বলে জানান ওই মৎস্য কর্মকর্তা।
মৎস্য বিভাগের তথ্যমতে, বাগেরহাট জেলায় ৭২ হাজার ১৯০ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৭০৯টি চিংড়ি ঘের রয়েছে। এর মধ্যে ৫২ হাজার ৫৩৬ হেক্টর জমিতে ৩৫ হাজার ৭৩৪টি বাগদা এবং ১৯ হাজার ৬৫৪ হেক্টর জমিতে ৪২ হাজার ৯৭৫টি গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। প্রায় ৬০ হাজার চাষি চিংড়ি চাষের সাথে জড়িত রয়েছেন। ১৯১৭-১৮ অর্থ বছরে বাগেরহাটে চিংড়ি উৎপাদন হয়েছে ৩২ হাজার ৮৫ মেট্রিক টন।
হিমায়িত খাদ্য রপ্তানিকারক এসোসিয়েশনের সাবেক পরিচালক এস হুমায়ুন কবির জানান, বিগত সময়ে ঘেরে একবার বাগদা চিংড়ি চাষ করা হলেও এখন দুইবার করা হচ্ছে। এ কারণে তুলনামূলকভাবে বাগদার আকার ছোট হচ্ছে। আট থেকে ১২টিতে কেজি (গ্রেড অনুসারে) এবং ১৩ থেকে ১৫টিতে কেজি এই সাইজের বাগদা বাজারে পাওয়া যাচ্ছে না। বাজারে বেশি পাওয়া যাচ্ছে ২১ থেকে ৩০ এবং ৩১ থেকে ৪০টিতে কেজি সাইজের বাগদা। সংগত কারণেই ছোট চিংড়ির মূল্য কম হবে। তবে আন্তজার্তিক বাজারে বড় চিংড়ির মূল্য স্থিতিশীল রয়েছে বলে জানান তিনি।
তিনি আরও জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে ছয় থেকে দশটির সাইজের এক পাউন্ড বাগদার মূল্য আট থেকে নয় ইউএস ডলার এবং ২১ থেকে ৩০টির সাইজের এক পাউন্ড বাগদার মূল্য সাড়ে তিন থেকে চার ইউএস ডলার।
এস হুমায়ুন কবিরের দেয়া তথ্যমতে, আমাদের দেশের অধিকাংশ হিমায়িত খাদ্যো বেলজিয়াম, জার্মান, নেদারল্যান্ড, ইটালি, সুইসারল্যান্ডসহ ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। শতকরা ৮৫ ভাগ হিমায়িত খাদ্যো ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানি করা হয়। হিমায়িত খাদ্য রপ্তানি করে গত অর্থ বছর ৫২৮ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়েছে, যা দেশীয় মুদ্রায় প্রায় চারহাজার ৭০০ কোটি টাকা।
তিনি বলেন, চিংড়ি রপ্তানির জন্য নতুন নতুন দেশ খুঁজতে হবে। বিশ্ববাজারে ক্রেতাদের আগ্রহী করে তুলতে হবে। এক্ষেত্রে অর্থনৈতিক অবস্থা ভাল এমন সব দেশে আমাদের দেশের চিংড়ির প্রদর্শনী করা প্রয়োজন। ইউএনবি।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.