‘কর্মহীন’দের জন্য ৪ কার্যক্রমে বরাদ্দ ৭৬০ কোটি টাকা

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব মোকাবেলায় দেশে সাধারণ ছুটির পাশাপাশি বন্ধ রয়েছে যানবাহন, নানা প্রতিষ্ঠান, কল কারখানা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান। এর ফলে দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যান চালক, মটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। কর্ম হারানো এসব লোকদের সহায়তা করতে ৭৬০ কোটি টাকা বরাদ্দের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার সন্ধ্যায় জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া ভাষণে তিনি এ কথা জানান।

গণভবনে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের কারণে যারা কর্ম হারিয়েছেন, ব্যাংক হিসাবসহ তাদের নামের তালিকা দ্রুত তৈরি করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকা সম্পন্ন হলেই তাদের ব্যাংক হিসাবে এককালীন নগদ অর্থ পাঠানো হবে।

জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক আর্থিক সংস্থা আভাস দিচ্ছে যে, করোনাভাইসের কারণে বিশ্ব আজ অর্থনৈতিক মন্দার সম্মুখীন হতে যাচ্ছে। আপনারা জানেন, এই ভাইরাস প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায় হচ্ছে কোয়ারেন্টাইন বা নিজেকে ঘরবন্দি করে রাখা। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কোথাও গণছুটি কোথাও কারফিউ কোথাও লকডাউন ঘোষণা করা হয়েছে। ফলে বিশ্বের ২৫০ কোটিরও বেশি মানুষ আজ ঘরবন্দি। বাংলাদেশেও গত ২৫ মার্চ থেকে আগামী ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত একটানা ৩২ দিন সাধারণ ছুটি চলছে। জরুরি সেবা কার্যক্রম ছাড়া সবকিছু বন্ধ রয়েছে। সেইসঙ্গে দেশের বেশিরভাগ শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং ছোট-খাটো কারখানাও বন্ধ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একই কারণে গণপরিবহন ও বিমান চলাচল বন্ধ রয়েছে। আমাদের আমদানি-রপ্তানির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। মরণঘাতী এই ভাইরাসের কারণে বেশিরভাগ দেশে প্রবাসী ভাইবোনেরা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। ফলে স্থবিরতা এসেছে রেমিট্যান্স প্রবাহে। আমরা যেহেতু বিশ্ব ব্যবস্থার বাইরে নই সেহেতু বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দার ধাক্কা আমাদের অর্থনীতির জন্য দুঃচিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’

তিনি বলেন, ‘এই সংকট কতদিন চলবে কিংবা আমাদের অর্থনীতিকেই বা কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করবে, তা আমরা জানি না। তারপরও সম্ভাব্য অর্থনৈতিক নেতিবাচক প্রভাব মোকাবেলায় আমরা কাজ করছি। এর অংশ হিসেবে ইতোমধ্যে ৯৫ হাজার ৬১৯ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ আমরা ঘোষণা করেছি। যা জিডিপির ৩ দশমিক ৩ শতাংশ।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনীতির ওপর সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় আমরা চারটি মূল কার্যক্রম নির্ধারণ করেছি। যা চলতি অর্থবছরের অবশিষ্ট তিন মাস, স্বল্প-মেয়াদে -আগামী অর্থবছরে এবং মধ্য মেয়াদে ও পরবর্তী তিন অর্থবছর - এই তিন পর্যায়ে বাস্তবায়ন করা হবে।’

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত চারটি কার্যক্রম হলো-

(১) সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: এক্ষেত্রে কর্মসৃজনকেই প্রাধান্য দেওয়া হবে।

(২) আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ প্রণয়ন: অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুন্ন রাখাই হলো এই প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।

(৩) সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: এই কার্যক্রমের মাধ্যমে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে।

(৪) মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ এমনভাবে বৃদ্ধি করা যেন মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।

এ ছাড়া বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমসমূহ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট সংকট মোকাবেলায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর সুরক্ষায় কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো-

(১) স্বল্প-আয়ের মানুষদের বিনামূল্যে খাদ্য সামগ্রী বিতরণের লক্ষ্যে ২ হাজার ৫০৩ কোটি টাকার ৫ লাখ মেট্রিক টন চাল এবং ১ লাখ মেট্রিক টন গম বরাদ্দ করা হয়েছে।

(২) শহরাঞ্চলে বসবাসরত নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে আগামী তিন মাসে ওএমএসের আওতায় ১০ টাকা কেজি দরে ৭৪ হাজার মেট্রিক টন চাল বিক্রি করা হবে। এ জন্য ২৫১ কোটি টাকা ভর্তুকি দেওয়া হবে।

(৩) দিনমজুর, রিকশা বা ভ্যান চালক, মটর শ্রমিক, নির্মাণ শ্র্রমিক, পত্রিকার হকার, হোটেল শ্র্রমিকসহ অন্যান্য পেশার মানুষ- যারা দীর্ঘ ছুটি বা আংশিক লকডাউনের কারণে কর্ম হারিয়েছেন- ব্যাংক হিসাবসহ তাদের নামের তালিকা দ্রুত তৈরির করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তালিকাটি সম্পন্ন হলে এককালীন নগদ অর্থ তাদের ব্যাংক হিসাবে পাঠানো হবে। এ খাতে ৭৬০ কোটি বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

(৪) এ ছাড়া সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতায় পরিচালিত ‘বয়স্ক ভাতা’ ও ‘বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের জন্য ভাতা’ কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা হবে। এ জন্য বাজেটে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮১৫ কোটি টাকা।

(৫) জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহ নির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। এ বাবদ সর্বমোট ২ হাজার ১৩০ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হবে। যাতে কেউ গৃহহীন না থাকে।

অন্যদিকে, ক্ষতিগ্রস্ত শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ৩০ হাজার কোটি টাকা, অতি-ক্ষুদ্র, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের ওয়ার্কিং ক্যাপিটালের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে।

এ ছাড়া এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানোর লক্ষ্যে ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা, প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিমের আওতায় ৫ হাজার কোটি টাকা এবং রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার বিশেষ ঋণ সুবিধার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

উৎপাদন খাতের সঙ্গে জড়িতদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এই দুঃসময়ে আমাদের কৃষি উৎপাদন ব্যবস্থা শুধু সচল রাখলেই চলবে না, বরং আরো জোরদার করতে হবে। আগামীতে যেন খাদ্য সংকট না হয়, সে জন্য একখণ্ড জমিও ফেলে রাখা যাবে না। এ জন্য কৃষির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কোনো কৃষি উপকরণের ঘাটতি যাতে না হয় এবং সময়মতো কৃষকের হাতে যাবতীয় উপকরণ পৌঁছে যায় সে ব্যবস্থা আমরা করেছি। কৃষক যাতে এবার বোরো ধানের ন্যায্যমূল্য পান সেজন্য চলতি মওসুমে গত বছরের চেয়ে ২ লাখ মেট্রিক টন ধান বেশি কেনা হবে। এ জন্য অতিরিক্ত ব্যয় হবে ৮৬০ কোটি টাকা। আর কৃষি যন্ত্রপাতি কেনার জন্য বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২০০ কোটি টাকা।’

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরো বলেন, ‘কৃষি খাতে চলতি মূলধন সরবরাহের লক্ষ্যে পাঁচ হাজার কোটি টাকার একটি তহবিল গঠন করা হচ্ছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষিদের কৃষি, মৎস্য, ডেইরি এবং পোল্ট্রি খাতে ৪ শতাংশ সুদহারে এ তহবিল থেকে ঋণ দেওয়া হবে। সেইসঙ্গে কৃষিতে ভর্তুকি বাবদ সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে।’