বৈরুত বিস্ফোরণ: মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন চিকিৎসকরা

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণে কেঁপে উঠে লেবাননের রাজধানী বৈরুত। এতে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয় গোটা শহর। বিস্ফোরণের তীব্রতা এতই বেশি ছিলো যে, সেখানে ৩ দশমিক ৫ মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হয়। এর তীব্রতা টের পাওয়া যায় বৈরুত শহর থেকে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরে ভূমধ্যসাগরের অপর প্রান্তে অবস্থিত সাইপ্রাসেও।

বিস্ফোরণের পর রোগীতে ভরে যায় বৈরুতে হাসপাতালগুলো

ভয়াবহ এ বিস্ফোরণে এখন পর্যন্ত ৪ বাংলাদেশি প্রবাসীসহ কমপক্ষে ১৩৫ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আহত হয়েছেন ৫ হাজারের বেশি মানুষ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে বৈরুতে দুই সপ্তাহের জন্য জরুরি অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকে থাকাদের উদ্ধার কাজ এখনো চলমান রয়েছে। ঘটনার পর পরই হতাহতদের জরুরি সেবা প্রদানে নেমে পড়েন চিকিৎসকরা। তাদের বর্ণনায় উঠে এসেছে এ মর্মান্তিক ঘটনার ভয়াবহতা।

এ বিষয়ে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আরব নিউজকে দেওয়া বর্ণনায় বৈরুতের ক্লেমেনসেউ মেডিকেল সেন্টারের কার্ডিওলজি বিভাগের চিকিৎসক ডা. ওয়ালিদ আলামি বলেন, এ ঘটনায় পুরো শহরটি ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। চারদিকে শুধু রক্ত আর রক্ত। সবাই এদিক-সেদিক ছোটাছুটি করছেন। কেউ হতাহতদের উদ্ধার করছেন। কেউ তাদের হাসপাতালে আনছেন।

বিস্ফোরণের পর রোগীতে ভরে যায় বৈরুতে হাসপাতালগুলো

এ ঘটনায় হতাহতদের চিকিৎসা দেওয়া হাসপাতালগুলোর মধ্যে ক্লেমেনসেউ মেডিকেল সেন্টার অন্যতম। বিস্ফোরণে হাসপাতালটির একটি বড় অংশও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

ডা. ওয়ালিদ আলামি বলেন, এ ঘটনায় সবচেয়ে বেশি হতাহত হয়েছে শিশুরা। গুরুতর আহতদের বেশিরভাগই শিশু। তাদের অনেকে চোখে আঘাত পেয়েছে। বিস্ফোরণের ফলে কাঁচের টুকরা ছুটে গিয়ে চোখসহ শরীরের অনেক জায়গায় বিদ্ধ হয়েছে। এতে অনেকে চোখের দৃষ্টি হারিয়েছেন। অনেকে রক্তাক্ত অবস্থায় চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে ছুটে আসছেন।

৫৮ বছর বয়সী এ চিকিৎসক আরো বলেন, তিনি গৃহযুদ্ধ দেখে বড় হয়েছেন। ২০০৬ সালের ইসরায়েলের বিপক্ষে যুদ্ধের সময়ও তিনি হতাহতদের চিকিৎসা দিয়েছেন। কিন্তু এবারের মতো ভয়াবহ পরিস্থিতিতে তিনি আর পড়েননি। এত মর্মান্তিক দৃশ্য তিনি আর দেখেননি। এত বেশি পরিমাণ রোগী হাসপাতালে আসছে যে, তাদের খুব অল্প সময়ের মধ্যে রোগীদের জরুরি চিকিৎসা দিতে হচ্ছে।

গত মঙ্গলবার লেবাননের রাজধানী বৈরুতে ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ

হতাহতদের চিকিৎসা দেওয়া আরেকটি হাসপাতাল হলো আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব বৈরুত। এ হাসপাতালের চিকিৎসক সার্জন ডা. রামজি আলামি ঘটনার বর্ণনা দিয়ে বলেন, বিস্ফোরণে শহরের অনেক বহুতল ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বিধ্বস্ত হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে গেছে অনেক স্থাপনা। চারদিকে রক্তাক্ত অবস্থায় মানুষ ছোটাছুটি করছে। হাসপাতাগুলো ভরে গেছে আহত রোগীতে। এত বেশি সংখ্যক রোগী এসেছে যে অনেককে শুধু প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিস্ফোরণের ভয়াবহতা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। এত বেশি রোগীদের চিকিৎসা দিতে গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা হিমশিম খাচ্ছে। শুধু গুরুতর রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। তারপর রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য হাসপাতালের করিডোর পর্যন্ত খুলে দেওয়া হয়েছে। বিস্ফোরণের পর গোটা শহরে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এর মধ্যেই তাদের রোগীদের চিকিৎসা সেবা দিতে হয়েছে।

তিনি আরো বলেন, বিস্ফোরণে তীব্রতায় মানুষ নিজের জায়গা থেকে ছিটক যায়। কেউ দেয়ালের সঙ্গে ধাক্কা খায়, কেউ বাতাসে ভেসে উঠে। এতে অনেকে মাথায় আঘাত পেয়েছেন। কাঁচের টুকরায় অনেকের শরীরে কেটে রক্তক্ষরণ হয়েছে। অনেকে শারীরিভাবে আঘাতপ্রাপ্ত না হলেও বিস্ফোরণের ভয়াবহতা দেখে ট্রমায় ভুগছেন।

গত মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বৈরুত বন্দরের কাছে এ জোড়া বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। দেশটির স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্দরের কাছে একটি রাসায়নিক গুদাম থেকে এ বিস্ফোরণ ঘটে। যেখানে গত ৬ বছর ধরে ২ হাজার ৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট অরক্ষিত অবস্থায় পড়ে ছিলো।

পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দেশটিতে দুই সপ্তাহের জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে। এ ছাড়া মৃতদের স্মরণে সেখানে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক চলছে।