১৯ বছর পর খালাস পেলেন “সন্ত্রাসবাদে” অভিযুক্ত ১২৭ ভারতীয় মুসলিম
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর রাতের কথা। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক মোহাম্মদ আব্দুল হাই ভারতের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের রাজাস্থানের যোধপুর থেকে ট্রেনে পড়ে রওনা দিয়েছিলেন গুজরাটের শহর সুরাতে। উদ্দেশ্য ছিলো মুসলিম শিক্ষার একটি আয়োজনে অংশগ্রহণ করা। কিন্তু তিনি জানতেন না তার এই নির্দোষ সফর তার জীবনই চিরতরে বদলে দিবে।
আয়োজনটির আয়োজক ছিলো সর্বভারতীয় সংখ্যালঘু শিক্ষা বোর্ড। যোধপুরের জয় নারায়ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক আব্দুল হাই ছিলেন এই আয়োজনের একজন সদস্য।
তিনদিনের আয়োজনে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের অন্তত ৪০০ শিক্ষাবিদ, অধিকারকর্মী ও সামাজিক নেতাদের অংশগ্রহণের কথা ছিলো।
আব্দুল হাই এই আয়োজন নিয়ে খুবই রোমাঞ্চিত ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না এই আয়োজন থেকেই তাকে “সন্ত্রাসী” হিসবে গ্রেপ্তার করা হবে, তাকে ১৪ মাস জেলে থাকতে হবে এবং ১৯ বছর ধরে তার বিচার চলবে।
২৭ ডিসেম্বর রাত আনুমানিক ১১টার দিকে রাজেশ্রী হলে পুলিশ হানা দেয়। সুরাটের এই হলে আব্দুল হাই এবং আরো ১২০ জন লোক অবস্থান করছিলেন।
তাদের সবাইকে পুলিশ বিভিন্ন অভিযোগ গ্রেপ্তার করে। বেআইনি কার্যকলাপ এবং কঠোর সন্ত্রাস বিরোধী আইনে তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদেরকে স্টুডেন্ট ইসলামিক মুভমেন্ট অব ইন্ডিয়া (এসআইএমই)-এর সদস্য হিসেবে মিথ্যাভাবে চিহ্নিত করা হয়। এই সংগঠনটি ভারতে নিষিদ্ধ।
সব মিলিয়ে ১২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং তাদের সবাই ছিলেন মুসলিম।
এইভাবে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রায় সবাই জামিন পেয়েছেন ঠিক; কিন্তু তাদের বিচার চলেছে প্রায় দুই দশক ধরে। গত রোববার ১৯ বছরের বিচার শেষে সবাইকে নিরাপরাধ হিসেবে মুক্তি দেওয়া হয়েছে।
এই সুদীর্ঘ বিচার প্রক্রিয়ায় ১২৭ জনের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দাবি এসআইএমআই ভারতের বিভিন্ন স্থানে বোমাবাজির জন্য দায়ী এবং পাকিস্তানের অস্ত্রধারী কোনো সংগঠনের সাথে তাদের সংযোগ আছে। এই সংগঠনের শত শত সদস্যকে আটক করা হয়েছে। কিন্তু তাদের দাবি তারা শুধুই ভারতীয় মুসলিমদের ইসলামি জীবন ব্যবস্থা শিক্ষা দেওয়ার জন্য কাজ করে।
প্রায় ২০ বছরের দীর্ঘ অগ্নীপরীক্ষা
চলতি মাসের ছয় তারিখে সুরাত কোর্ট এক রায়ে বলেছে যে, অভিযোগকারিরা নির্ভরযোগ্য, অকাট্য ও সন্তোষজনক কোনো প্রমাণ হাজির করতে পারেননি, এমনকি এসআইএমআই-এর সাথে আব্দুল হাই বা অন্য কারো কোনো সংশ্লিষ্টতা প্রমাণ করতে পারেননি। ফলে তাদের বিরুদ্ধে কোনো শাস্তি দেওয়া যাচ্ছে না।
আব্দুল হাই সংবাদ মাধ্যমকে বলেন, “এই মামলা আমার এবং আমাদের সবার জীবনে ও পরিবারে ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। আমাদের অনেকে সরকারি চাকরি হারিয়েছে, অনেকে আর কোনো চাকরিই পাননি জীবনে।”
তিনি আরো বলেন, “২০০১ সালের ২৭ ডিসেম্বর আমি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক ছিলাম। ২০১৫ সালে আমি একই পদ থেকে অবসরে যাই। এই দীর্ঘ সময়ে আমাকে কোনো পদোন্নতি দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া সরকারি চাকুরেরা অবসরের সময় যে ভাতা পায়, আমাকে সেটাও দেওয়া হয়নি।”
আব্দুর হাইয়ের মতো বিড়ম্বনায় পড়তে হয়েছে প্রায় সবাইকেই। যেমন আসিফ ইকবাল গ্রেপ্তার হওয়ার সময় একজন স্বাস্থ্যকর্মী হিসেবে কাজ করতেন। কিন্তু এই মামলার পর তার চাকরি চলে যায়।
তিনি বলেন, “আমি আমার কর্মকর্তাদের বলেছি যে এই মামলার আমার বিরুদ্ধে কোনো দোষ প্রমাণিত হয়নি। সুতরাং আমাকে কাজ করতে দিন। কিন্তু তারা আমার কথা শোনেননি।” চাকরি থেকে বহিস্কার না করলে ২০২৭ সাল পর্যন্ত কাজ করতে পারতেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, “এই মামলা আমার জীবন শেষ করে দিয়েছে। আমার ৭৫ বছর বয়সী বাবা এখনো অটো রিকশা চালিয়ে সংসার চালান। আমি কিছুই করতে পারি না। বিষয়টি আমাকে খুবই পীড়া দেয়।”
খালাস পাওয়ার পর তিনি তাকে চাকরিতে বহাল করার এবং ক্ষতিপূরণ দেওয়ার দাবি করেছেন।
তার মতোই বিপদে পড়েছেন আসিফ শেখ। গ্রেপ্তারের সময় তিনি গুজরাট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতার উপর একটি ডিগ্রি নিচ্ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা শিক্ষার্থীদের একজন হওয়ার পরও তার কোনোদিন সাংবাদিক হওয়া হয়নি। এই মামলার কারণে তাকে এসআইএমআই-এর একজন হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
তিনি বলেন, “আমাকে অন্যায়ভাবে একটি সংগঠনের সদস্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। ফলে কেউ চাকরি দেয়নি। আমি সাংবাদিক হতে চেয়েছিলাম। কিন্তু আমাকে এখন মশলা বিক্রি করে সংসার চালাতে হয়।”
ভারতে স্পষ্টত মুসলিম বিদ্বেষ
গত কয়েক দশকে কয়েক শত মুসলমান ভারতে ভুয়া অভিযোগে গ্রেপ্তার হয়েছেন। বেশির ভাগই পরে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হয়েছেন। কিন্তু বিচার প্রক্রিয়ায় কেটে গেছে বছরের পর বছর— কখনো কখনো কয়েক দশক।
২০১৮ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে ভারতের বেশির ভাগ মুসলিম দেশটির পুলিশ কর্তৃক বৈষম্যের ভয় পান। গবেষণাটি পরিচালনা করেছে অলাভজনক সংস্থা কমন কজ অ্যান্ড লোকনিটি।
গবেষণাটির ফলাফলে বলা হয়েছে, ৪৭ শতাংশ ভারতীয় মুসলিম সন্ত্রাসবাদের মিথ্যা অভিযোগে অভিযুক্ত হওয়ার ভয় পান।
২০১৯ সালে একই প্রতিষ্ঠানের আরো একটি গবেষণায় বলা হয়েছে, ভারতের পুলিশ মুসলমান নাগরিকদের বিরুদ্ধে স্পষ্টত বৈষম্য করে। ভারতীয় পুলিশের অর্ধেক লোকবলই মনে করেন যে, “মুসলমানরা প্রকৃতিগতভাবেই অপরাধপ্রবণ”।
দক্ষিণ এশিয়ার মানবাধিকার বিষয়ক সংস্থা হিউম্যান রাইটস ডকুমেন্টেশন সেন্টারের নির্বাহী পরিচালক রাভি নাইর এ বিষয়ে বলেন, “সত্য কথা হলো দীর্ঘ সময় ধরে মামলা চললে যারা ক্ষতিগ্রস্ত হন, তাদেরকে আসলে ক্ষতিপূরণ দেওয়া হয় না। একই সাথে যে পুলিশ সদস্যরা মিথ্যা মামলা সাজান, ভুয়া ডকুমেন্ট তৈরি করে বিচার প্রক্রিয়া দীর্ঘ করেন, তাদেরও কোনো বিচারের ব্যবস্থা নেই। এতেই বোঝা যায় বিচার প্রক্রিয়ায় জটিলতা আছে।”
মানবাধিকার লংঘনের পরও পুলিশ এবং সরকারি কর্মীরা কোনো সাজা পান না। কিন্তু তাদেরকে অবশ্যই, সবার আগে, চাকরিচ্যুত করতে হবে, না হলে বিচার ব্যবস্থা ঠিক হবে না, এমন মন্তব্য রাভি নাইরের।
আসিফ শেখ অবশ্য বলছেন, তিনি ক্ষতিপূরণ চান না। তার চাওয়া হলো ভারতের মুসলিমরা যাতে অন্য মুসলিমদের ভালোর জন্য কাজ করেন।
তিনি বলেন, “ভুয়া ও বানোয়াট মামলা মুসলমানদের মধ্যে এক ধরনের ভীতি তৈরি করেছে। শিক্ষা দেওয়ার আয়োজন থেকে যদি ২০ বছরর মামলা পড়তে হয়, তাহলে এটা কী মানে বোঝায়? এটা শুধু ভয় তৈরি করে। যে ভয়ের কারণে মুসলমানদের পক্ষে কেউ কথা বলে না।”
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.