এবার পুতিন ব্লেয়ারসহ বিশ্বনেতাদের আর্থিক কেলেঙ্কারি ফাঁস

বিশ্বনেতা, রাজনীতিবিদ ও বিলিয়নিয়রদের গোপন সম্পদ ও আর্থিক লেনদেনের সবচেয়ে বড় কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছে। এ ঘটনাকে প্যান্ডোরা পেপার্স কেলেঙ্কারি হিসেবে আখ্যায়িত করা হচ্ছে। এ কেলেঙ্কারিতে উঠে এসেছে ৩৫ বর্তমান ও সাবেক বিশ্বনেতাসহ ৩০০ এর বেশি সরকারি কর্মকর্তাদের আর্থিক দুর্নীতি ও সম্পদ গোপনের তথ্য।

ফিনসেন ফাইলস, প্যারাডাইস পেপারস, পানামা পেপারস এবং লাক্সলিক্সের পর গত সাত বছরের মধ্যে এটি সর্বশেষ আর্থিক কেলেঙ্কারির ঘটনা। প্যান্ডোরা পেপার্স প্রস্তুত করেছে ওয়াশিংটন ডিসির ইন্টারন্যাশনাল কনসোর্টিয়াম অব ইনভেস্টিগেটিভ জার্নালিস্টস (আইসিআইজে) টিম। যেখানে ১১৭টি দেশের ৬৫০ এরও বেশি সাংবাদিক অংশ নিয়েছেন।

এই নথিতে বিরাট অংশ জুড়ে রয়েছে জর্দানের রাজা আবদুল্লাহর অর্থ লোপাটের তথ্য। নথিতে বলা হয়েছে, ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড ও আরও মার্কিন ডলারের সম্পদ তিনি গোপনে গড়ে তুলেছেন। নথিতে নাম রয়েছে যুক্তরাজ্যের সাবেক প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার ও তার স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারের নাম।

নথি থেকে জানা যাচ্ছে, সেন্ট্রাল লন্ডনে একটি অফিস কেনার সময় ব্লেয়ার দম্পতি ৩ লাখ ১২ হাজার পাউন্ড ট্যাক্স ফাঁকি দিয়েছিলেন। নথিতে নাম আছে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনেরও। তার বিরুদ্ধে মোনাকোতে গোপন সম্পদ গড়ে তোলার অভিযোগ রয়েছে। চেক প্রজাতন্ত্রের প্রধানমন্ত্রী আন্দ্রেজ বাবিসের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি ফ্রান্সের দক্ষিণে গোপনে ১২ মিলিয়ন পাউন্ডের দুটি ভিলা কিনেছেন। এই সপ্তাহের শেষের দিকে তিনি তার দেশে নির্বাচনের মুখোমুখি হচ্ছেন। তিনি একটি অফশোর বিনিয়োগ কোম্পানি ঘোষণা দিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পর ভিলা দুটি কেনেন।

বিবিসি, প্যানোরামা, গার্ডিয়াান এবং অন্যান্য মিডিয়া কোম্পানির যৌথ তদন্তে এসব নথিগুলো সংগ্রহ করা হয়েছে বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চল থেকে। এর মধ্যে রয়েছে ব্রিটিশ ভার্জিন দ্বীপপুঞ্জ, পানামা, বেলিজ, সাইপ্রাস, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর এবং সুইজারল্যান্ডসহ ১৪টি আর্থিক পরিষেবা সংস্থা। যাতে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে ১২ মিলিয়ন বা এক কোটি ২০ লাখ নথি। পরিসংখ্যানগুলো সবই দুর্নীতি, অর্থপাচার এবং বৈশ্বিক কর পরিহারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট।

কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হল, বিশ্বের বিশিষ্ট এবং ধনী ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যে গোপনে সম্পত্তি কেনার জন্য বৈধ কোম্পানি স্থাপন করেছেন। নথিতে ৯৫ হাজার অফশোর কোম্পানির মালিকদের কেনাকাটার তথ্য প্রকাশ করা হয়েছে। এ ঘটনা একটি বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছে, তা হল- বারবার প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পরও অফশোর কোম্পানির মালিকদের একটি রেজিস্ট্রার চালু করতে যুক্তরাজ্য সরকার ব্যর্থ হয়েছে। ক্রেতারা অর্থপাচার কার্যক্রম গোপন করতে পারে এমন উদ্বেগের মধ্যেই এই কেলেঙ্কোরি ফাঁস হল।

এর মধ্যে একটি উদাহরণ হল, আজারবাইজানের প্রেসিডেন্ট ইলহাম আলিয়েভ এবং তার পরিবার। যাদের বিরুদ্ধে নিজের দেশ লুণ্ঠনের অভিযোগ রয়েছে। তদন্তে দেখা গেছে আলিয়েভ ও তার ঘনিষ্ঠ সহযোগীরা গোপনে যুক্তরাজ্যে ৪০০ মিলিয়ন পাউন্ডেরও বেশি সম্পদের গোপন কারবারি করেছে। আজারবাইজানের প্রেসিডেন্টের এই কেলেঙ্কোরি যুক্তরাজ্য সরকারের জন্য বিব্রতকর হতে পারে।

আইসিআইজের তদন্তকারীরা বলছেন, সম্পত্তির বিশাল গোপন বাক্স এই তদন্তে উম্মুক্ত হয়ে পড়েছে। এজন্য এই কেলেঙ্কারির নাম দেওয়া হয়েছে ‘প্যান্ডোরা পেপার্স’। ফাঁস হওয়া আর্থিক দলিলগুলো দেখিয়েছে জর্ডানের রাজা আবদুল্লাহ কিভাবে গোপনে যুক্তরাজ্যে ৭০ মিলিয়ন পাউন্ড বা ১০০ মিলিয়ন ডলারের বেশি সম্পদ গড়ে তুলেছেন। তবে বাদশাহ আবদুল্লাহর আইনজীবীরা বলছেন, সমস্ত সম্পত্তি ব্যক্তিগত সম্পদ দিয়ে কেনা হয়েছে। যা তিনি জর্ডানের নাগরিকদের জন্য প্রকল্পে অর্থায়ন করতেও ব্যবহার করেন।

এদিকে নথিতে দেখা গেছে কিভাবে আজারবেইজানের শাসক আলিয়েভ ও তার পরিবার গোপনে অফশোর কোম্পানি ব্যবহার করে যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি অর্জন করেছে। এমনকি প্রেসিডেন্ট আলিয়েভের ১১ বছরের ছেলে হায়দার আলিয়েভের নামে লন্ডনে ৩৩ মিলিয়ন পাউন্ডের অফিস ব্লকসহ ১৭টি সম্পত্তি কেনা হয়েছে।

তবে প্যান্ডোরা পেপার্সে টনি ব্লেয়ার ও চেরি ব্লেয়ারের সম্পদ লুকানোর তথ্য নেই। কিন্তু নথিতে বলা হচ্ছে, তারা ৪৫৫ মিলিয়ন ডলারের সম্পত্তি কিনেও শুল্ক পরিশোধ করেনি। লেবার পার্টির সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী এবং তার ব্যারিস্টার স্ত্রী চেরি ব্লেয়াল ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সেন্ট্রাল লন্ডনের মেরিলেবনে ভবনটি অধিগ্রহণ করেন, যেটি তার মালিকানাধীন অফশোর কোম্পানি কিনেছিল। এইভাবে সম্পদ অর্জন করা যুক্তরাজ্যে বৈধ ও শুল্ক দিতে হয় না, কিন্তু এর আগে টনি ব্লেয়ার নিজেই এর ধরনের কর ফাঁকির সমালোচনা করেছিলেন।