দুদকের অভিযোগ, লিখিত জবাবে যা বললেন শরীফ

বিভিন্ন অভিযোগ তুলে আলোচিত দুর্নীতি দমন কমিশন, দুদকের উপ-সহকারী পরিচালক শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় হলে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ উত্থাপন করেন সংস্থাটির সচিব মো. মাহবুব হোসেন। এবার সে সব অভিযোগের লিখিত জবাব দিয়েছেন শরীফ উদ্দিন।

শরীফ উদ্দিন ও মাহবুব হোসেন, ফাইল ছবি

অভিযোগ করা হয়, দুদককে পাশ কাটিয়ে, আদালতের অনুমতি নেওয়ার বাধ্যবাধকতা তোয়াক্কা না করে লিখিতভাবে ১৫টি ব্যাংক হিসাব এবং মৌখিকভাবে ৮টি ব্যাংক হিসাব জব্দ করে শরীফ। অনুসন্ধান ও তদন্তের স্বার্থে কারো ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ফ্রিজ করার ক্ষেত্রে আইন ও বিধির তোয়াক্কা না করা এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে না জানানোও তার অপরাধ। এর জবাবে শরীফ বলেন, ব্যাংকে টাকা জব্দ করার আদেশ দেননি, তদন্তের স্বার্থে তাৎক্ষণিকভাবে অপরাধলব্ধ টাকাগুলো তোলা সাময়িক বন্ধ রাখার অনুরোধপত্র দেন। তাতে বিজ্ঞ আদালতের মাধ্যমে এ ব্যাপারে শিগগির অবহিত করা হবে, এটাও লেখা ছিল।

দুদক সচিবের অভিযোগ, কক্সবাজারে র‌্যাবের অভিযানে সার্ভেয়ারের বাসা থেকে ঘুষের ৯৩ লাখ ৬০ হাজার ১৫০ টাকা জব্দ করা হয়, যা কর্তৃপক্ষকে না জানিয়ে এক বছর নিজের হেফাজতে রাখে শরীফ। এর জবাবে শরীফ বলেন, জব্দ করা আলামতের অর্থ তদন্তকারীর কাছে রাখার নজির দুদকে প্রচুর রয়েছে। ওই অর্থ তার কাছে না রাখার ব্যাপারে কোনো বাধ্যবাধকতা নেই আইনে।

দুদক ভবন, ফাইল ছবি

এক মামলায় ভুক্তভোগীকে জবানবন্দি নিতে নির্মমভাবে নির্যাতনের অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি করেছেন শরীফ উদ্দিন। ওই ব্যক্তিকে ভূমি অধিগ্রহণ মামলায় গ্রেপ্তার, আদালতের মাধ্যমে রিমান্ডে নেওয়া হয়েছিল এবং ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছেন বলে জানান তিনি।

জনস্বার্থে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করার একমাস পর যোগদান করে দুদকের আদেশ অবজ্ঞা করা এবং কর্মস্থল ত্যাগের সময় সকল রেকর্ডপত্রসহ নথিপত্র বুঝিয়ে দেওয়ার বিধান অমান্য করার অভিযোগ করেছে দুদক। এ বিষয়ে শরীফ বলেন, বদলির সময় করোনায় আক্রান্ত থাকার কথা লিখিতভাবে দুদককে জানানো হয়েছে। চাকরিবিধিতেও অনিবার্য কারণে সর্বোচ্চ ৩০ দিন পর নতুন কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার সুযোগ রয়েছে। করোনায় আক্রান্তের সনদ দেওয়ার পরেও বিভাগীয় মামলার শিকার হন তিনি।

অনুসন্ধান ও তদন্তের নথি বুঝিয়ে না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে শরীফ বলেন, নথি বুঝে নেওয়ার জন্য চট্টগ্রাম থেকে তাকে অবমুক্তি করার আগে ৩ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। এর মধ্যেই করোনাকালীন কঠোর বিধিনিষেধ ঘোষণা করা হয়, ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হই। বিভাগীয় মামলায় নির্দেশপ্রাপ্তির পর নথি হস্তান্তরে ২ মাস ২১ দিন দেরি করার অভিযোগ ভ্রান্তিকর। ১৩০টি নথির চালান তৈরি থালেও তা সিডিতে সংরক্ষণ করা সময়সাপেক্ষ ছিল। এ ছাড়া পটুয়াখালীতে অনুসন্ধান বা তদন্তের কোনো নথিই ছিল না তার কাছে, হয়রানির প্রশ্নই ওঠে না।

কর্মকাল ৩ বছর পার হওয়ায় অন্য ২০ জনের সঙ্গে বদলি করা হয়, যা সবাই হাইকোর্টে রিট করে সেটি স্থগিতের চেষ্টা করা- এমন অভিযোগের এসেছে। এর জবাবে শরীফ বলছেন, রিটকারী শহিদুল ইসলামকে আমি চিনি না। এখন চাকরিচ্যুতির ঘটনায় আমার নিরাপত্তা চেয়ে ১০ আইনজীবী হাইকোর্টে একটি চিঠি দিয়েছেন, তাও জানা ছিল না। নিজে থেকে কেউ আইনি পদক্ষেপ নিলে আমার কী করণীয়?

কক্সবাজার জেলার জমি অধিগ্রহণের মামলা তদন্তের প্রতিবেদনে দুদকের নির্দেশনা অনুসরণ না করার অভিযোগ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন শরীফ। তিনি জানতে চান, তার দেওয়া প্রতিবেদনে ঠিক না থাকলে সংশোধনের নির্দেশনা দেওয়া হল না কেন? তা ছাড়া কোনো জিজ্ঞাসা থাকলে আমাকে দিয়েই সংশোধন করা যেতো।

কর্ণফুলী গ্যাসের অভিযোগের তদন্তের দায়িত্ব পাওয়ার পর চাপ দিয়ে ছোট ভাইকে বিজ্ঞাপন ছাড়াই চাকরি দেওয়া এবং আত্মীয়কে জাল সনদে চাকরি দেওয়া। বিষয়টি তদন্তাধীন রয়েছে বলে জানিয়েন দুদক সচিব। এর জবাবে শরীফ বলেছেন, বাবার কর্মসূত্রে চট্টগ্রামের ষোলশহরে থাকায় শিহাবসহ অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক চাকরি হয়েছে কর্ণফুলী গ্যাস কোম্পানিতে। সে সময়ের কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক খায়েজ আহম্মদ মজুমদারকে জিজ্ঞাস করলেই চাপের বিষয়ে জানা যাবে। আর যে আত্মীয়র কথা বলা হচ্ছে, তেমন কেউ নেই আমার।

দুদক সচিব অভিযোগ করেন, অনুসন্ধান বা তদন্তের সময় অভিযোগের সঙ্গে সরাসরি জড়িত না থাকা বহু লোককে নোটিশ বা টেলিফোনে ডেকে হয়রানি করা। এ বিষেয় শরীফ উদ্দিন বলেন, সাড়ে ৭ বছরের চাকরিজীবনে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। এমন কিছু থেকে থাকলে বিস্তারিত প্রকাশ করা হতো।

জনৈক ব্যক্তির হুমকির অভিযোগে থানায় জিডি করলেও কাউকে অবহিত না করা এবং সহযোগিতা নেওয়ার আগ্রহ না দেখানোর অভিযোগ করা হয়েছে। জবাবে শরীফ বলেন, জিডি করার পর দুদক সচিব ও বিভাগীয় কার্যালয়কে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে। মুঠোফোনেও দুদকের কয়েকজন কর্মকর্তাকে বিষয়টি জানানো হয়, তারাই জিডি করার পরামর্শ দেন।

এর আগে গত ১৬ ফেব্রুয়ারি দুদক চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর সই করা এক অফিস আদেশে শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়। ওই দিন সন্ধ্যা থেকেই আদেশ কার্যকরের কথা বলা হয় তাতে। ২০০৮ সালের দুদক চাকরি বিধির ৫৪ (২)-এর ক্ষমতাবলে এই আদেশ দেওয়ার কথা জানানো হয়।

ওই আদেশের প্রতিবাদে পরদিন দুদকের প্রধান কার্যালয়সহ ২১ জেলায় মানববন্ধন করেন সংস্থাটির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তার আগে দুদক সচিবের বরাবর একটি স্মারকলিপিও পেশ করেন তারা। এর ফলে বিষয়টি গণমাধ্যমসহ বিভিন্ন সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।

প্রসঙ্গত, বৃহত্তর চট্টগ্রামে দুর্নীতি বিরোধী অভিযান পরিচালনা করে ব্যাপক প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন শরীফ উদ্দিন। কিন্তু তারপরও দুদক পরিচালক মুহাম্মদ মনিরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত এক অফিস আদেশে গত বছর ১৬ জুন শরীফ উদ্দিনকে চট্টগ্রাম থেকে পটুয়াখালীতে বদলি করা হয়।