‘গলাকাটা মোশারফ’ গ্রেপ্তার, যা করতো তার বাহিনী

মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ তার নাম। বয়স ৪৫ বছর। বাড়ি ভোলা জেলার বোরহানউদ্দীন উপজেলায়। মাত্র ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে সে। ১৯৯০ সালে জীবিকার প্রয়োজনে ঢাকায় চলে আসে।

গলাকাটা মোশারফ

রাজধানীতে এসে প্রথমে বেবি ট্যাক্সি ও সিএনজি চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করতো। পরবর্তীতে হাউজিং প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে সে। ২০০০ সালে ঢাকার কাফরুল থানা এলাকায় ছিনতাইয়ের মাধ্যমে অপরাধ জগতে প্রবেশ করে মোশারফ।

পরবর্তীতে গাংচিল বাহিনীর প্রধান আনারের মাধ্যমে সেই বাহিনীতে প্রবেশ করে এবং অল্পদিনের মধ্যেই আনারের অন্যতম সহযোগীতে পরিণত হয়। ২০১৭ সালে আনারের মৃত্যুর পর গাংচিল বাহিনী বিভক্ত হয়ে যায়। মূল অংশের নেতৃত্বে থাকে লম্বু মোশারফ। উচ্চতায় লম্বা হওয়ায় তাকে লম্বু মোশারফ এবং মারামারিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী কার্যক্রমের সময় ভুক্তভোগীকে গলায় ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করার কারণে সে ‘গলাকাটা মোশারফ’ হিসেবেও পরিচিতি পায়।

সংশ্লিষ্টরা জানায়, গলাকাটা মোশারফ তার দলের সদস্যদের মাধ্যমে মোহাম্মদপুর ও এর পার্শ্ববর্তী তুরাগ, আমিনবাজার, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ, সাভার এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, ভূমিদখলসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করত। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার কারণে সে বিভিন্ন সময় মোহাম্মদপুর, কেরানীগঞ্জ, কাফরুল এলাকায় আত্মগোপনে থাকত।

তার বিরুদ্ধে রাজধানীর বিভিন্ন থানায় হত্যাচেষ্টা, ছিনতাই, ডাকাতি, অবৈধ অস্ত্র, মাদক ব্যবসা, ধর্ষণ, অপহরণ, পুলিশ অ্যাসল্টসহ বিভিন্ন অপরাধে ১৫টির অধিক মামলা রয়েছে। এছাড়া সে বিভিন্ন মেয়াদে একাধিকবার কারাবরণও করেছে।

সেই আলোচিত সন্ত্রাসী মোহাম্মদপুরের ‘মোশারফ বাহিনী’র মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী মোশারফ হোসেন ওরফে লম্বু মোশারফ ওরফে গলাকাটা মোশারফ ওরফে গাংচিল মোশারফকে তার ৫ সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করেছে র‍্যাব। এ সময় উদ্ধার করা হয়েছে বিদেশী আগ্নেয়াস্ত্র, গোলাবারুদ, দেশীয় অস্ত্র ও মাদক।

র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উয়িংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা জানিয়েছেন। তিনি জানান, বিভিন্ন সময়ে অভিযোগের ভিত্তিতে জানা যায়, রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও এর পাশ্ববর্তী বিভিন্ন এলাকায় কতিপয় দুর্বৃত্ত নৌপথ, মার্কেট, বাস স্ট্যান্ড ও হাউজিং প্রতিষ্ঠান কেন্দ্রিক চাঁদাবাজি, ছিনতাই, অপহরণ, হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধ কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে আসছে। এর প্রেক্ষিতে সম্প্রতি র‌্যাব-২ এর অভিযানে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে শীর্ষ সন্ত্রাসী কবির হোসেনকে তার সহযোগীসহ গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারের পর কবিরের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বেরিয়ে আসে শীর্ষ সন্ত্রাসী লম্বু মোশারফের বিষয়টি। সে তথ্যের ওপর ভিত্তি করে র‌্যাব-২ লম্বু মোশারফ ও তার সহযোগীদের আইনের আওতায় নিয়ে আসতে গোয়েন্দা নজরদারী বৃদ্ধি করে।

তিনি আরও জানান, গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে র‌্যাব-২ এর একটি দল গতকাল ২৭ ফেব্রয়ারি রাতে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করে। গ্রেপ্তার করা হয় সন্ত্রাসী মোশারফ ও তার ৫ সহযোগীকে। গ্রেপ্তারকৃত অন্যরা হলেন- মো. বিল্লাল ওরফে চোরা বিল্লাল, মো. মোহন ওরফে বাইক মোহন, সাহাবুদ্দিন সাবু ওরফে জলদস্যু সাবু, মো. রুবেল ওরফে ডাকাত রুবেল এবং মো. সুমন মিয়া ওরফে সুমন হোসেন।

অভিযানে জব্দ করা হয় একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, ৪ রাউন্ড গোলাবারুদ, ৩টি বড় ছোরা, ২টি চাপাতি, ২টি চাকু, একটি চাইনিজ কুড়াল, একটি দা, একটি ফ্রেমসহ হেসকো ব্লেড, একটি গ্রীল কাটার, একটি কাটার প্লাস, ৪২৩ পিস ইয়াবা, ৫টি মোবাইল এবং নগদ অর্থ।

আসামীদের জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে র‍্যাব জানায়, গ্রেপ্তারকৃতরা দীর্ঘদিন ধরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর ও তার পার্শ্ববর্তী আমিনবাজার, তুরাগ, হাজারীবাগ, কেরানীগঞ্জ ও সাভারসহ বিভিন্ন এলাকায় ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ডাকাতি, ধর্ষণ, মাদক ব্যবসাসহ নানা রকম সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালিয়ে আসছে।

তাদের সন্ত্রাসী দলের সদস্য সংখ্যা ২৫-৩০ জন। লম্বু মোশারফের নেতৃত্বে দলের সদস্যরা বিভিন্ন গ্রুপে বিভক্ত হয়ে এলাকায় জমি দখল, হাউজিংয়ে চাঁদাবাজি, নৌপথে চাঁদাবাজি, মার্কেট ও বাসস্ট্যান্ডে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, ডাকাতি, অপহরণ ও মাদক ব্যবসাসহ অন্যান্য অপরাধ কার্যক্রম পরিচালনা করত।

লম্বু মোশারফের নির্দেশে তার সহযোগীরা বুড়িগঙ্গা ও তুরাগ নদীতে বালু ভর্তি ট্রলার, ইটের কার্গো ও অন্যান্য জাহাজ আটকে চাঁদাবাজি ও ডাকাতি পরিচালনা করত। এছাড়া সাভার ও তুরাগ এলাকার ইট ভাটার মালিকদের নিকট মাসিক ভিত্তিতে চাঁদা আদায় করত। তারা মোহাম্মদপুর ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন হাউজিংয়ে নির্মানাধীন ভবন, নতুন বাড়ির মালিক ও ব্যবসায়ীদের নিকট জমি দখলের নামে চাঁদাবাজি করত। কেউ চাঁদা দিলে শুরু হতো নির্যাতন।

র‍্যাব আরও জানায়, গাংচিল বাহিনী ছিল রাজধানীর পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের কাছে ভয় ও আতঙ্কের নাম। তাদের এসব অপরাধ কর্মকাণ্ডে বাধা প্রদান করার কারণে বিভিন্ন সময় আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ওপরও হামলা করেছে। মোহাম্মদপুরসহ আশপাশের এলাকায় আধিপত্য বজায় রাখাসহ অপরাধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে একাধিক কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণ করত মোশারফ।