সড়ক চকচকে করে যারা, তাদের জীবনগল্প আধারে ভরা!

রাত তখন ৩টা ১৫ মিনিট। মিরপুর-২ এলাকার একটি নীরব সড়ক। মাঝেমধ্যে দুই একটা সিএনজি বা মোটরসাইকেল চলাচল করছিল। সড়কে নেই কোনো মানুষের আনাগোনা। হঠাৎ চোখে পড়ল এক নারীকে। সড়কের পাশে ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে কিছু একটা খাচ্ছিলেন তিনি।

রেনু

কাছে যেতেই তাড়াহুড়ো করে উঠে দাঁড়িয়ে গেলেন ওই নারী। মুখ নড়াচড়া দেখে বোঝা গেল, পান খাচ্ছেন তিনি। বয়স ৪৫। এক হাতে বিশাল এক ঝাড়ু। গায়ের পোশাক বলছে, তিনি সিটি করপোরেশনের একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী।

নাম জানতে চাইলে তিনি উত্তর দেন, রেনু। এরপর কথা শুরু হয় তার সাথে। রেনু বলেন, ‘সিটি করপোরেশনের ঝাড়ুদার হিসেবে চাকরি করছি প্রায় ২০ বছর। আমাদের ডিউটি রাত ৩টা থেকে সকাল ৯টা পর্যন্ত। বেতন পাই ১৭ হাজার টাকা।’

বেতন তো বেশ ভালোই, শুধু রাতে কষ্ট করতে হয়- এই মন্তব্য শুনে কিছুটা রেগে গেলেন তিনি। বললেন, ‘আজকাল এই বেতনে ঠিকমতো পেট চলে না। সংসারে ৩টা ম্যাইয়া, একটা ছেলে। স্বামী রিকশা চালাইতো। এক্সিডেন্ট কইরা এখন বিছানায় পড়ে আছে। সব খরচ তো আমারেই দেখতে হয়।’

‘ডিউটি শেষে বাসায় যাইয়া একটু ঘুমাইয়া লই। দিনে কি আর সেই রকমের ঘুম হয়? এরপর বিকেল বেলা দুই বাসায় বুয়ার কাম করি। তাও সংসারে চালাইতে পারি না। জিনিসপত্রের যে দাম ব্যাইড়া গেছে, আমাগো মত গরীব মানুষের কি সংসার চালানো সম্ভব?’

ছেলেমেয়েরা কী করে, জানতে চাইলে রেনু বলেন, ‘গরীবের পোলামাইয়ার আবার পড়ালেখা কী! তয় স্কুলে দিছিলাম ম্যাইয়াদের, কিন্তু পড়ালেখা করতে পারে নাই। একটারে বিয়া দিছি আর দুইটারে বাসায় কামে দিছিলাম। কিন্তু এখনকার মানুষের স্বভাবচরিত্র ভালো না। ছোট ছোট ম্যাইয়াগো দিকেও খারাপ নজর দেয়। তাই আর কামে পাঠাই না। ছেলেটা তো ছোট তাই কোন কামে দিতে পারি না।’

কয়েক মিনিট কথা বলেই ঝাড়ু হাতে নেমে পড়েন রেনু।

ময়লা টানতে মানে ঝাড়ু দিতে কেমন লাগে, জানতে চাইলে রেনু বিজ্ঞের মতো বলেন, ‘ময়লা তো ঝাড়ু দেই না আসলে হরেক রকম মানুষ কুড়াই আমরা। আপনারা সারাদিন কত দামি দামি খাবার খান- চিপস, বিস্কুট, সিগারেট, ফলমুল, হোটেলের ফেলানো খাবার, সেগুলো আমরা কুড়াই। প্যাকেট কুড়াই প্রতিদিন, কিন্তু ওইসব দামি দামি খাবার চোখেও দেখি না!’

রেনুর সাথে কথা শেষ করে আরেকটু সামনে এগিয়ে যেতেই দেখা মিলল দুজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীর। তাদের সাথেও কথা হয়। রাবেয়া নামের এক নারী জানান, ১০ বছর ধরে তিনি চাকরি করছেন সিটি করপোরেশনে। সংসারে দুই সন্তান। স্বামীহারা রাবেয়া নিজেই সন্তানদের পড়াশোনা করাচ্ছেন।

এক ছেলে মিরপুরের স্থানীয় একটি কলেজে পড়াশোনা করছে। আরেক ছেলে সরকারি প্রাইমারি স্কুলে। রাবেয়া বলেন, ‘যা বেতন পাই কোনোমতে টেনেটুনে সংসার চালাই। বিকেলে আবার এই রাস্তায় চা-পান বিক্রি করি। তাতে বাড়তি কিছু টাকা আয় হয়।’

রাবেয়ার সাথে থাকা দুলালির জীবনটা একটু ভিন্ন। দুলালি বলেন, ‘বাবামায়ের একমাত্র মেয়ে ছিলাম। খুব আদর করতো আমারে। পড়ালেখাও করাতে চাইছিল। কিন্তু হঠাৎ বাপে একটা বিয়ে করে। এরপর আর আমাদের খোঁজ নেয় না। মা অনেক কষ্ট করে মানুষের বাড়িতে কাম কইরা আমারে বড় করছে। একটা বিয়াও দিছিলো।’

দুলালির কণ্ঠে আক্ষেপ ঝরে, ‘মায়ের মতো আমারও কপাল পোড়া, স্বামী ছাইড়া দিছে আমারে। একটা ছোট ছেলে আছে। মা অসুস্থ তাই কাম করতে পারে না। আমারেই এখন মা-ছেলের দেখাশোনা করতে হয়। পুরুষ মানুষ নাই সংসারে, তাই খরচাপাতি নিজেদেরই চালাতে হয়।’

কথা শেষ না হতেই ময়লা টানা সিটি করপোরেশনের ট্রাক প্রবেশ করে ওই সড়কে। সেটা দেখেই ঝাড়ু করা ময়লা ট্রলিতে নিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান ওই নারীরা।