ইউক্রেনে সত্যিই কি জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র?

ইউক্রেনে যুক্তরাষ্ট্রের জীবাণু পরীক্ষণ কার্যক্রম নিয়ে উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদে। মার্কিন সরকার ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে এ মর্মে রাশিয়ার অভিযোগের প্রেক্ষিতে শুক্রবার পরিষদের বৈঠক হয়। বৈঠকে মার্কিন রাষ্ট্রদূত রাশিয়ার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করলেও ইউক্রেনে ৩০টির বেশি জৈব পরীক্ষাগারে যুক্তরাষ্ট্রের সংশ্লিষ্টতা ও কর্মকাণ্ড নিয়ে ধোঁয়াশা কাটছে না। বরং জীবাণু অস্ত্রের অভিযোগ সামনে আসার পর থেকে মার্কিন কর্মকর্তাদের নানা মন্তব্য রাশিয়ার অভিযোগকে ঘিরে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র-তত্ত্বকেই জোরালো করছে।

ইউক্রেনে সত্যিই কি জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র?

রাশিয়া অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র সরকার ইউক্রেনে ‘সামরিক জৈব কার্যক্রম’ অর্থায়ন করছে। অর্থাৎ, ইউক্রেনে বিভিন্ন ল্যাবে জীবাণু অস্ত্র তৈরি করছে যুক্তরাষ্ট্র। জাতিসংঘে রুশ রাষ্ট্রদূত ভাসিলি নেবেনঝিয়া বলেছেন, মার্কিন কর্মকাণ্ডের ফলে ইউক্রেন থেকে পুরো ইউরোপে ক্ষতিকর জীবাণু ছড়িয়ে পড়ার মারাত্মক ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। জবাবে মার্কিন রাষ্ট্রদূত লিন্ডা টমাস-গ্রিনফিল্ড বলেছেন, রাশিয়া হয়তো ইউক্রেনের উপর নিজেদের জীবাণু অস্ত্র প্রয়োগের অজুহাত তৈরি করতে এমন অভিযোগ সামনে এনেছে।

লিন্ডা গ্রিনফিল্ড যা-ই বলুন, ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ রাশিয়ার দিক থেকে নতুন নয়। রুশ কর্মকর্তারা একাধিকবার প্রসঙ্গটি তুলেছেন। সবশেষ, গত রোববার রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক টুইটে বলেছে- যুক্তরাষ্ট্র ও ইউক্রেন জীবাণু অস্ত্র তৈরির গোপন কর্মসূচি চালাচ্ছে। গোপন কর্মকাণ্ড লুকাতে ইউক্রেনের একটি ল্যাবে ‘ইমার্জেন্সি ক্লিন-আপ’ করা হয়েছে, এমন প্রমাণ রুশ সৈন্যরা পেয়েছে বলেও টুইটে উল্লেখ করা হয়। ইউক্রেনের খারকিভ ও পোলতাভা শহরে যুক্তরাষ্ট্রের গোপন ল্যাব পরিচালনার কিছু নথিপত্রও হাতে পাবার দাবি করেছে রাশিয়া।

রাশিয়ার দিক থেকে যতবার ইউক্রেনে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ এসেছে, যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবারই তা গুজব ও মিথ্যা প্রচারণা বলে উড়িয়ে দিয়েছে। এমনকি মূলধারার বাইরের বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম ও ব্লগাররা এ নিয়ে লিখলেও যুক্তরাষ্ট্র সরকার সেগুলোকে রাশিয়ার মিথ্যা প্রোপাগান্ডা অভিহিত করে নাকচ করেছে। ইউক্রেনে জীবাণু কার্যক্রম নিয়ে সবরকম প্রশ্নে যুক্তরাষ্ট্রের জবাব গত মঙ্গলবার পর্যন্ত ছিল ‘না’।

যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগ নতুন মাত্রা পেয়েছে গত মঙ্গলবার মার্কিন সিনেটে এক শুনানির পর থেকে। মার্কিন উপ-সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড এদিন রিপাবলিকান দলীয় সিনেটর মার্কো রুবিওর এক প্রশ্নের জবাবে ইউক্রেনে জীবাণু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকাণ্ডের কথা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নিয়েছেন। প্রশ্নোত্তরের এক পর্যায়ে ফ্লোরিডার সিনেটর মার্কো রুবিও বলেন- ইউক্রেনের কাছে কি রাসায়নিক অথবা জীবাণু অস্ত্র আছে? জবাবে নুল্যান্ড বলেন- ‘ইউক্রেনের কিছু জৈব পরীক্ষণ কার্যক্রম রয়েছে যেগুলোর নিয়ন্ত্রণ পেতে রুশ সৈন্যরা, রুশ বাহিনী চেষ্টা চালাচ্ছে বলে এই মর্মে আমরা সত্যিকারের উদ্বেগ বোধ করছি। আমরা ইউক্রেনীয়দের সঙ্গে মিলে কাজ করছি যাতে রুশরা কোনোভাবে এগুলো হাতে না পায়।’

ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের মন্তব্যের একদিনের মাথায় চীন সরকারও ইউক্রেনে জীবাণু কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। বুধবার বেইজিংয়ে নিয়মিত প্রেস ব্রিফিংয়ে চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি ইউক্রেনে তাদের বায়োলজিক্যাল ল্যাবগুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানানোর এবং এসব ল্যাবের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, ‘‘বিরাজমান পরিস্থিতি মাথায় রেখে এবং ইউক্রেন, এই অঞ্চল ও সারাবিশ্বের মানুষের স্বাস্থ্য ও সুরক্ষার কথা ভেবে চিন সব পক্ষের, বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি এসব ল্যাবরেটরির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার এবং ল্যাবরেটরিগুলোতে সংরক্ষিত ভাইরাস ও পরীক্ষণ কার্যক্রম সংক্রান্ত তথ্য শেয়ার করার আহ্বান জানাচ্ছে।’’

বিশ্বের অন্তত ৩০ দেশে মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ৩৩৬টি বায়োলজিক্যাল ল্যাব পরিচালনা করছে বলে জানিয়েছে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ব গণমাধ্যম সিজিটিএন নেটওয়ার্ক। আর রুশ সরকার বলেছে, বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র যেসব বায়োলজিক্যাল ল্যাব চালাচ্ছে, তার মধ্যে অন্তত ৩০টি ইউক্রেনে অবস্থিত। মার্কিন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নিছক জনস্বার্থে ওষুধ তৈরির জন্য দেশে দেশে ল্যাব তৈরি করছে না, মন্তব্য করেছেন মার্কিন টিভি উপস্থাপক টাকার কার্লসন। ইউক্রেনের ল্যাবগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র যদি জীবাণু নিয়ে নিরীহ গোছের গবেষণা করে থাকে, তাহলে সেগুলো রুশদের হাতে পড়া নিয়ে এমন উদ্বেগ কেন, সে প্রশ্নও তুলেছেন কার্লসন।

জীবাণু অস্ত্র নিয়ে রাশিয়ার অভিযোগ যখন জোরালো হয়ে উঠেছে ঠিক সে সময় ইন্টারনেট ও গণমাধ্যমে ভিন্নধারার ও রাশিয়ার পক্ষের আউটলেটগুলোর উপর শুরু হওয়া গত কয়েকদিনের দমন-পীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সন্দেহ আরও উসকে দিচ্ছে। গুগল, ইউটিউব থেকে শুরু করে ফেসবুক, টুইটার সর্বত্র রাশিয়ার সরকারি গণমাধ্যমকে ব্লক করা হয়েছে। ফেসবুক, টুইটার ও ইনস্টাগ্রামে রাশিয়ার বিভিন্ন দূতাবাস ও মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল অ্যাকাউন্ট সাসপেন্ড করা হয়েছে। এমনকি ফেসবুক ও টুইটারে বিভিন্ন ইনডিপেনডেন্ট ব্লগারের অ্যাকাউন্টও ব্লক অথবা সাসপেন্ড করা হয়েছে। রাশিয়ার পক্ষের ও ক্ষেত্রবিশেষে নিরপেক্ষ ভাষ্য বন্ধে এমন নানামুখী উদ্যোগের মাঝে যুক্তরাষ্ট্র সরকার গত দুইদিনে নিজেরাই যেন তথ্যযুদ্ধে নেমে পড়েছে।

বৃহস্পতি ও শুক্রবার ইউটিউব ও টিকটক ইনফ্লুয়েন্সারদের নিয়ে পরপর দুটি বৈঠক করেছেন হোয়াইট হাউসের কর্মকর্তারা। মাঠের লড়াই থেকে বহুদূরে থেকেও ইন্টারনেটে তথ্যযুদ্ধে মার্কিন সরকারের এমন আটঘাট বেঁধে নামা দেখে জীবাণু অস্ত্র তৈরির অভিযোগের মুখে যুক্তরাষ্ট্রের অস্বস্তিই বেশি চোখে পড়ছে।