৩০ বছরের সাধনা: ঢাকার সড়কে চলছে ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্স’

শনিবার ২৬ মার্চ বিকেলে ৪টা। রাজধানীর মানিক মিয়া এভিনিউ। সরকারি ছুটির দিন হওয়ায় ঘুরতে এসেছেন শত শত মানুষ। হঠাৎ সেখানে মাথা ঘুরে পড়ে যান ৫৫ বছর বয়সী এক বৃদ্ধা। মুহূর্তেই লোকজন জড়ো হয়ে যায় তার চারপাশে। ভিড় ঠেলে ওই নারীর কাছে চলে আসেন মনিরুল নামে এক ব্যক্তি। এসেই ওই নারীর হাত ধরে পালস পরীক্ষা করছিলেন তিনি।

মনিরুলের ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্স’

ততক্ষণে ওই নারীর সাথে থাকা স্বজনেরা তাকে হাসপাতালে নেওয়ার জন্য অ্যাম্বুলেন্স ও গাড়ির জন্য ছোটাছুটি শুরু করেছেন। তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে মনিরুল নামের সেই ব্যক্তি বললেন, অ্যাম্বুলেন্সের দরকার নেই। গরমে প্রেশারের কারণে এ অবস্থা হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্সও লাগলে তিনি নিজেই তাকে নিয়ে যাবেন। এরমধ্যেই চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে এবং পানি পান করার ফলে স্বাভাবিক হলেন ওই নারী।

তখন সেখান থেকে উঠে গিয়ে নিজের ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্সে’ বসে পড়লেন মনিরুল। বাজাতে থাকলেন দেশাত্মবোধক গান। এবার সকলের চোখ পড়ল মনিরুলের সেই ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্সে’। লাল সবুজের পতাকায় মোড়ানো একটি বিশাল আকৃতির নৌকা দাঁড়িয়ে আছে মানিক মিয়া এভিনিউতে। নৌকার সামনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং পেছনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশাল বড় দুটি ছবি। আর নৌকার সামনে রয়েছে বাংলাদেশের একটি পতাকা।

মনিরুলের ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্স’

নৌকার সামনের অংশে রয়েছে ছোট একটি ব্যানার, সেখানে লেখা রয়েছে— ‘বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৌকায় বিনামুল্যে চিকিৎসা দেওয়া হয়। পরিচালনায় মো. মনিরুল ইসলাম।’

এবার কথা হয় নৌকার মালিক মনিরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমার নাম মনিরুল ইসলাম। একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলের সেট ডিজাইনের চাকরি করি। আমার বাড়ি খুলনার কয়রা উপজেলায়। সংসারে দুই সন্তান ও স্ত্রী রয়েছে। বসবাস করি কামরাঙ্গীরচর এলাকার একটি ভাড়া বাসায়।’

মনিরুলের ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্স’, পাশে দাঁড়িয়ে মনিরুল ইসলাম

এই নৌকা কিভাবে বানিয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটি একটি ব্যাটারি চার্জার ইজিবাইক। এটার ওপরে আমি নিজে ডিজাইন করে এই নৌকা বানাইছি। এটা চার্জেই চলে।’

এটি বানানোর কারণ কি? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি গত ৩০ বছর যাবত চেষ্টা করছি এমন একটা নৌকার বাহন বানিয়ে মানুষের সেবা করব। দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে ঘুরে মানুষের কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান ও স্বাধীনতার স্মৃতিগুলো তুলে ধরব।’

মনিরুলের ‘নৌকা অ্যাম্বুলেন্স’, পাশে মনিরুল ইসলাম

এই নৌকা দিয়ে কি কি কাজ করেন— এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমার এই নৌকার ভেতর অ্যাম্বুলেন্সের মতো অনেক সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। কিছু প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাও রয়েছে। রাস্তায় কোনো মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাই এই নৌকা অ্যাম্বুলেন্সে করে। বহু মানুষকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়েছি আমি।’

যন্ত্রটি তৈরিতে কত টাকা খরচ হয়েছে এবং কত দিন সময় লেগেছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘৩০ বছর যাবত স্বপ্ন দেখেছি। ছোট চাকরি করি, তাই বেতন কম। কিছু টাকা জোগাড় করেছি। তবুও হয়নি, শেষে আমার বাড়িতে একটা জমি বিক্রি করেছি। এটা বানাতে আমার ১০ লাখ টাকা খরচ হয়েছে।’

মনিরুল বলেন, ‘যেহেতু আমি চাকরি করি, তাই সারাদিন তো চালাতে পারি না। এ কারণে একজন ড্রাইভার রেখেছি। সে ১৮/২০ ঘণ্টা ঢাকায় ঘুরে ঘুরে রোগী টানে। হাসপাতালে নিয়ে যায়, বাসায় পৌঁছে দেয়। এই কাজটা পুরোপুরি ফ্রি করি আমরা।’

ভবিষ্যতে কোনো চাওয়া রয়েছে কি না— জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার স্বপ্ন একটা— বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য বানানো এই নৌকা অ্যাম্বুলেন্স নিয়ে দেশের ৬৪ জেলায় ঘুরবো। কিন্তু টাকার অভাবে তা সম্ভব হয় না।’