শ্রীলঙ্কায় ‘হারিয়ে যাচ্ছেন’ মধ্যবিত্তরা
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সাচ্ছন্দ্য থেকে রীতিমতো সংকটে পড়ে হারিয়ে যাচ্ছে শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়। জীবনমানের দ্রুত অবনমন ঘটছে। সংখ্যাগরিষ্ঠ সিংহলিদের নববর্ষ আর সংখ্যালঘু মুসলমানের ঈদ-দুটি বড় উৎসব একসঙ্গে এলেও কারও কেনাকাটা নেই, বেড়ানোর পরিকল্পনা নেই। চাল, লবণ, তেল, কেরোসিন, দুধ, সবজি আর গ্যাসের হিসাব কষেই পেরেশান সবাই।
চামারি সিলভা
আসবাবহীন, শূন্য লিভিংরুমের চারপাশটা পরখ করছেন চামারি সিলভা। এমন তো হবার কথা ছিল না। শ্রমজীবী পরিবারের মেয়ে তিনি। কয়েক দশকের কঠোর পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলেন লাক্সারি বুটিক শপ। কলম্বোর অন্যতম ব্যয়বহুল লোকালয়ে তার দোকান। প্রায়শ নিমন্ত্রণ পেতেন বড় বড় হোটেলের পার্টিতে। নিজের পরিবার, শ্বশুরবাড়ির লোকদের বেড়াতে নিয়ে গেছেন প্রথমে দুবাই, তারপর অস্ট্রেলিয়া। খোদ প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী নিয়মিত কেনাকাটা করতে আসতেন তার দোকানে।
‘এখন সব শেষ। নিষেধাজ্ঞার কারণে আমি আর পোশাক তৈরির উপকরণ আমদানি করতে পারছি না। অবশ্য, কলম্বোর মানুষেরও আর কেনাকাটার সামর্থ্য নেই। বিদেশ থেকে তো কেউ আমার পোশাক কিনতে আসবে না’- একনাগাড়ে বলে যান সিলভা। কলম্বোর বলগোডা লেকের পাড়ে অ্যাপার্টমেন্ট নিয়ে থাকতেন তিনি। সেটা ছিল তার স্বপ্নের বাড়ি। নিয়মিত ভাড়া টেনে যাওয়া সম্ভব না হওয়ায় দুই মাস আগে ওই অ্যাপার্টমেন্ট ছেড়ে স্বামী, সন্তানকে নিয়ে উঠেছেন নিজের ছোট ফ্যাক্টরিতে। এখানেই স্থায়ীভাবে থাকতে চান তিনি। বাড়িটি খালিই পড়ে আছে। পোকামাকড়ের বসতি হয়েছে সেখানে। সিলভা বলতে থাকেন- ‘আমি পুরো সিস্টেমের উপর ক্ষুদ্ধ। রাজনীতিবিদদের পেটানোর ইচ্ছা হচ্ছে। ভবিষ্যত নিয়ে কত পরিকল্পনা ছিল আমাদের। সব ভেস্তে গেছে। কালকে কি হবে এখন সেটাই জানি না।’
বিশ্বের অন্যতম ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকটে পড়েছে শ্রীলঙ্কা। তলানিতে ঠেকেছে দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। বৈদেশিক মুদ্রা সাশ্রয়ের জন্য সরকার অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ছাড়া সব আমদানি নিষিদ্ধ করেছে। এমন ঢালাও নিষেধাজ্ঞার কারণে শ্রীলঙ্কায় এশিয়ার সর্বোচ্চ মূল্যস্ফীতি দেখা দিয়েছে। শ্রীলঙ্কার রুপি হয়ে পড়েছে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে পারফর্মিং মুদ্রা।
শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্তের জীবিকা ধ্বংস হয়ে গেছে। দিনযাপনের খরচ টানতে গিয়ে উবে গেছে তাদের সঞ্চয়। কলম্বো সৈকতের হোটেলে আড্ডা, পার্টি আর বিদেশের কোন ইউনিভার্সিটিতে ছেলেমেয়েকে পড়াতে পাঠাবে, সেসব গল্প-পরামর্শ ভুলে মধ্যবিত্তরা এখন পরস্পরের কাছে খোঁজ নেয় কোন খাবারটি এখন সস্তা, শহরের কোথায় গেলে জ্বালানি কেনা যাবে- এইসব।
সবজির দাম বেড়েছে পাঁচগুণ, চালের বেড়েছে ৩০ শতাংশ। এক বস্তা সিমেন্ট এখন এক প্যাকেট দুধের চেয়ে দামি। ইউনিভার্সিটি অব পেরাদানিয়ার চলমান এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, পুষ্টিকর খাবার কিনতে অসমর্থ শ্রীলঙ্কানের হার দুই বছরে ১১ থেকে বেড়ে ৩৩ শতাংশ হয়েছে।
কলম্বোর অভিজাত বামবালাপিটিয়া এলাকায় চামারি সিলভার দোকান। অন্য যেকোনো বছরে এই সময়টায় দোকানে ব্যস্ততার কমতি থাকত না। বৌদ্ধ সিংহলিদের বর্ষবরণ আর মুসলমানদের রোজা চলছে। কিন্তু উৎসব-পার্বণ উপলক্ষে কোনো ক্রেতা নেই। রোববার ছুটির দিনেও সড়ক ফাঁকা। একে ক্রেতা নেই, তার উপর লোডশেডিং, জেনারেটরের ব্যয় বৃদ্ধি-এসব কারণে বেশিরভাগ কাপড়ের দোকান ও খাবার হোটেলের ঝাপ (শাটার) নামিয়ে রেখেছেন ব্যবসায়ীরা।
দ্য টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক চামারি সিলভার দোকানে থাকাবস্থায় সেখানে মাত্র একজন ক্রেতা আসেন। এক সময় লন্ডনে হোটেল চালাতেন লোকটি। সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী শ্রীলঙ্কায় সরকারি চাকুরে, এ কারণে পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘সবারই এখন এক অবস্থা। শ্রীলঙ্কায় মধ্যবিত্ত বলতে আর কিছু অবশিষ্ট নেই। সবার টাকাই অর্থহীন হয়ে পড়েছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্বের প্রতিটি দেশের সমস্যা আছে। তবে শ্রীলঙ্কার মতো সমস্যা কারও নেই। ছুটির মৌসুম চলছে, অথচ কেউ বেড়াতে বের হচ্ছে না। কারও সে সামর্থ্য নেই। একমাত্র সৃষ্টিকর্তা এখন আমাদের উদ্ধার করতে পারেন।’
প্রতিরক্ষামন্ত্রী থাকাকালে শ্রীলঙ্কার ২৬ বছরের গৃহযুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে তুমুল প্রশংসা পেয়েছিলেন গোতাবি রাজাপাকসা। ২০১৯ সালের নির্বাচনে তাই বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তাকে জিতিয়েছিল শ্রীলঙ্কার মধ্যবিত্ত মানুষেরা। এখন তারাই একের পর এক ভুল অর্থনৈতিক সিদ্ধান্তে শ্রীলঙ্কাকে পথে বসানোর জন্য গোতাবি রাজাপাকসাকে দুষছেন। গোতাবির ভাই প্রধানমন্ত্রী মহিন্দা রাজপাকসা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসা সরকারি ঠিকাদারি থেকে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছেন বলে সবার অভিযোগ।
চ্যাটাম হাউসের এশিয়া প্রোগ্রামের এসোসিয়েট ফেলো চারুলতা হগ বলেন- ‘রাজাপাকসাদের নৃতাত্ত্বিক-জাতীয়তাবাদী কর্তৃত্ববাদ, ঢালাও অর্থনৈতিক অব্যবস্থাপনা আর তার সঙ্গে কোভিড-জনিত প্রতিকূল পরিস্থিতি শ্রীলঙ্কার অর্থনীতির পালের হাওয়া কেড়ে নিয়েছে। অর্থনৈতিক অভিঘাত থেকে কেউ রেহাই পায়নি।’
চলমান অর্থনৈতিক সংকটের জন্য অনেকে ২০১৯ সালে অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসার একটি সিদ্ধান্তকে দায়ী করছেন। অর্থনীতিবিদদের সতর্কবার্তা অগ্রাহ্য করে তিনি তখন বেশকিছু কর মওকুফের ঘোষণা দিয়েছিলেন। এতে করে শ্রীলঙ্কার সার্বভৌম ঋণমান নেমে যাওয়ায় একপর্যায়ে দেশটি আন্তর্জাতিক ঋণ বাজারে প্রবেশের সুযোগ হারায়। আগে থেকে প্রায় ২১০০ কোটি পাউন্ড ঋণের ভারে থাকা শ্রীলঙ্কা তখন সার্বভৌম বন্ডের সুদ ও ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ খরচ করতে থাকে। ফলাফল আজকের পরিস্থিতি। বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে জরুরি ওষুধ, কাগজ পর্যন্ত কিনতে পারছে না দেশটি।
ধনী-গরিব নির্বিশেষে কলম্বোর মানুষেরা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে দোকানে লাইনে দাঁড়াচ্ছেন। কখনো কখনো সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেও খালি হাতে ফিরছেন অনেকে। গত কয়েক সপ্তাহ ধরে বিভিন্ন স্থানে যেসব বিক্ষোভ হচ্ছে সেখানে হোয়াইট কলার পেশাজীবী থেকে শুরু করে দিনমজুর সবাই যোগ দিচ্ছেন। কলম্বোর ভিসা অফিসগুলোতে শিক্ষিত মানুষের সমাগম বাড়ছে। সবাই দেশ ছেড়ে পালিয়ে বাঁচতে চাইছেন। কিন্তু শ্রীলঙ্কার রুপির বিনিময় হার যেভাবে কমেছে তাতে অনেকেই ভিসার খরচ বহন করতে পারছেন না। রোববার ব্যাংকগুলোতে প্রতি ডলারের বিপরীতে ৩৪০ লঙ্কান রুপি বিক্রি হচ্ছিল। মুদ্রাস্ফীতির এ খড়গ সবচেয়ে শক্তভাবে পড়েছে মধ্যবিত্তের ঘাড়ে।
কলম্বোর দেহিওয়ালা এলাকার অধিবাসী অরুণা নিশান্ত আলভিসের পরিবার দুমাস ধরে মাংস, পানীয়সহ বহু পণ্য কেনা বাদ দিয়েছে। ১৪ বছর বয়সী কন্যা কৌশিকে নিয়ে বেশি চিন্তিত আলভিস দম্পতি। মেধাবৃত্তি পাওয়া মেয়েটি গত মাস থেকে পড়তে পারছে না তীব্র লোডশেডিংয়ের কারণে।
কলম্বোর বাইরে ছোট শহর ও গ্রামগুলোর অধিবাসীদের অবস্থা আরও খারাপ। অনেক পরিবার ক্ষেতের ফসলে নিজেদের খাবার চাহিদা মেটানো নিয়ে শঙ্কায় পড়েছে। গত মে মাসে রাসায়নিক সার প্রয়োগ নিষিদ্ধ হবার পর থেকে শ্রীলঙ্কার এক-তৃতীয়াংশ ফসলি জমি এমনিতেই খালি পড়েছিল। এতে করে চাল উৎপাদন ৫০ শতাংশ হ্রাস পেয়েছিল বলে জানান পেরাদেনিয়া ইউনিভার্সিটির এগ্রিকালচারাল ইকোনমিকসের শিক্ষক জীবিকা বীরাহেওয়া। এবার যতটুকু আবাদ হচ্ছিল সেটাও ঝুঁকিতে পড়েছে লোডশেডিং ও জ্বালানি সংকটের কারণে যথাযথ সেচ না হওয়ায়।
ক্যান্ডি থেকে তিন ঘন্টার পথ পিতিগোদা গ্রাম। সেখানকার কৃষকরা জানান, তারা পরিবারের সদস্যদের নিয়ে দৈনিক এক বেলা খেয়ে বেঁচে আছেন। জ্বালানি কেনার টাকা অথবা ভাড়া না থাকায় হাসপাতাল ও স্কুল যাওয়া ছেড়ে দিয়েছে পিতিগোদার মানুষ। ৫৭ বছর বয়সী কৃষক মানান্নেলাগেদারা বীরাসিংহে বলেন- ‘গত বছর রাসায়নিক সার নিষিদ্ধ হওয়ায় আশানুরূপ ফলন হয়নি, তাই আমার আয়ও কমেছে। এখন চাল, আটা, চিনি ও ডালসহ সবকিছুর দাম অনেক বেড়ে গেছে। আমার জীবনে দেখা সবচেয়ে খারাপ সময় এটা।’
পিতিগোদার ক্ষুব্ধ কৃষকরা বলেন- ‘আমরা সবাই মিছিল নিয়ে প্রেসিডেন্টের বাসভবনে যাব ভেবেছিলাম। কিন্তু তেলের দাম যেভাবে বেড়েছে তাতে কলম্বো যাবার ভাড়া জোগাড় করাই কঠিন হয়ে পড়েছে।’ (দ্য টেলিগ্রাফ থেকে অনূদিত)
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.