ভারতে মাধ্যমিক সিলেবাস থেকে গণতন্ত্র, ইসলামি সাম্রাজ্য বাদ

মাধ্যমিক পর্যায়ের সিলেবাস থেকে গণতন্ত্র, বিশ্ব ইতিহাসে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতিক প্রভাব, মুঘল আমলের ইতিহাস, শিল্প বিপ্লব, জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনসহ বেশকিছু বিষয় বাদ দিয়েছে ভারতের সেন্ট্রাল বোর্ড অব সেকন্ডারি এডুকেশন (সিবিএসই)। শিক্ষাব্যবস্থাকে হিন্দুত্ববাদের দিকে নিয়ে যেতে বিজেপি সরকার এ পদক্ষেপ নিয়েছে বলে শিক্ষাবিদদের একাংশের অভিযোগ। খবর হিন্দুস্তান টাইমস ও আনন্দবাজার।

দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস সিলেবাস থেকে ‘দ্য মুঘল কোর্ট: রিকনস্ট্রাকটিং হিস্ট্রিজ থ্রো ক্রনিকলস’ অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে

২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষের সিলেবাস প্রকাশ করেছে সিবিএসই। এতে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণির পাঠক্রমে বেশকিছু পরিবর্তন এসেছে বলে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জানিয়েছেন। বিশেষত সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যবই থেকে ভারতের ক্ষমতাসীন দল বিজেপির ভাবধারার পরিপন্থী অধ্যায়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে।

সিবিএসই বলেছে, ভারতের ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেইনিং (এনসিইআরটি)-এর পরামর্শক্রমে সিলেবাস কাটছাঁট করা হয়েছে। তবে শিক্ষকরা এ পরিবর্তনে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।

একাদশ শ্রেণির ইতিহাস পাঠ্যক্রম থেকে বাদ দেওয়া অধ্যায়গুলোর মধ্যে রয়েছে ‘সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস’। এ অধ্যায়ে ইসলাম ধর্মের আবির্ভাব, খিলাফতের উত্থান, ইসলামী সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, আফ্রিকা-এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠা, অর্থনীতি ও সমাজে এর প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে বলে সিবিএসইর ওয়েবসাইটে জানা যায়। এখন থেকে অধ্যায়টি পড়তে হবে না বলে সিবিএসই জানিয়েছে। একাদশ শ্রেণির বই থেকে শিল্প বিপ্লব অধ্যায়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে।

একইভাবে দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস সিলেবাস থেকে ‘দ্য মুঘল কোর্ট: রিকনস্ট্রাকটিং হিস্ট্রিজ থ্রো ক্রনিকলস’ অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে। মুঘল আমলের সামাজিক, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ইতিহাস আলোচিত হয়েছে এ অধ্যায়ে। এনসিইআরটির নতুন পাঠ্যবইয়ে এ অধ্যায়টি থাকছে না।

জানা গেছে, দ্বাদশ শ্রেণির রাষ্ট্রবিজ্ঞান বই থেকে স্নায়ু যুদ্ধ ও জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো বাদ দেওয়া হয়েছে। জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের অন্যতম স্থপতি জওহরলাল নেহরুর কথা থাকায় অধ্যায়টি বাদ দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

রোহিনীর একটি সরকারি স্কুলে ইতিহাসের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার শর্তে হিন্দুস্তান টাইমসকে বলেন, আমাদের মতো ধর্মনিরপেক্ষ দেশে বিভিন্ন ধর্ম সম্পর্কে নাগরিকদের গভীর জ্ঞান থাকা জরুরি। সেন্ট্রাল ইসলামিক ল্যান্ডস অধ্যায়ে ইসলামের আবির্ভাব থেকে বর্তমান কাল পর্যন্ত বিস্তারিত পাঠ ছিল। একইভাবে মুঘল দরবার সংক্রান্ত অধ্যায়টি ছিল দ্বাদশ শ্রেণির সিলেবাসে মধ্যযুগের ইতিহাসের কেন্দ্রে। এ দুটি অধ্যায় বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ অযৌক্তিক।

দি ইন্ডিয়ান স্কুলের ইতিহাসের শিক্ষক কানু শর্মা বলেন, যেসব অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে সেগুলো এখনও অনেক প্রাসঙ্গিক। যেমন, মুঘল দরবার অধ্যায়ে ট্রান্সজেন্ডার জনগোষ্ঠীর কথা আছে। তখন তাদের কিভাবে সম্মান করা হত সেটা উল্লেখ আছে, যদিও এখন তারা নিজেদের অধিকারের জন্য যুঝছে। এ  অধ্যায়টি বাদ দিয়ে মুঘল প্রশাসনের অর্থনৈতিক ও রাজস্ব নীতি ঢুকানো হয়েছে, যা শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করবে না।

দিল্লির একটি বেসরকারি স্কুলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের একজন শিক্ষক নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে বলেন, দ্বি-মেরু বিশ্বব্যবস্থার অবসান (দি এন্ড অব বাইপোলারিটি) শীর্ষক অধ্যায়টির ভিত্তি ছিল স্নায়ু যুদ্ধ সংক্রান্ত অধ্যায়। স্নায়ু যুদ্ধ না পড়ালে পরের অধ্যায়টি পড়াতে পারব না।

এদিকে দশম শ্রেণির সমাজবিজ্ঞান বই থেকে ‘ধর্মনিরপেক্ষতা, সাম্প্রদায়িকতা এবং রাজনীতি’ অধ্যায় থেকে উর্দু কবি ফৈজ আহমেদ ফৈজের দুটি কবিতা বাদ দেওয়া হয়েছে। রাজনৈতিক পোস্টার সম্পর্কে পড়াতে ওই দুটি কবিতার উদ্ধৃতি দেওয়া হতো। এছাড়া একটি রাজনৈতিক কার্টুনও বাদ দেওয়া হয়েছে। একই বইয়ের ‘ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ডাইভার্সিটি’ অধ্যায়টিও বাদ দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করে সামাজিক বৈষম্য সম্বন্ধে শিক্ষার্থীদের সচেতন করতে অধ্যায়টি রাখা হয়েছিল।

এছাড়া অঙ্ক বই থেকেও বেশকিছু জরুরি অধ্যায় বাদ দেওয়া হয়েছে বলে কিছু স্কুল থেকে দাবি করা হয়েছে।

শিক্ষাবিদদের একাংশের অভিযোগ, এই পরিবর্তনের কারণ শিক্ষায় গৈরিকীকরণের চেষ্টা। ভারত তথা উপমহাদেশের ইতিহাস ‘নতুন করে’ লেখার উদ্দেশ্যে এই সব পরিবর্তন আনছে বিজেপি সরকারের অধীনে থাকা এনসিইআরটি। নরেন্দ্র মোদি সরকার একদিকে যেমন বিশ্ব ইতিহাসে ইসলাম ধর্ম ও সংস্কৃতির অবদান সম্বন্ধে নতুন প্রজন্মকে জানতে দিতে চায় না, তেমনই কমিউনিজম তথা সামাজিক বিপ্লবের ধারণাকেও পাঠ্যক্রমের আড়ালে নিয়ে যেতে চায়।