লাশের স্তূপে স্বার্থের ব্যবসা, মানবতা হচ্ছে নির্মমতার বলি
- Details
- by এম.এস.আই খান
ডাঙ্গায় গুলি, নির্যাতন আর ধর্ষিত হওয়ার ভয় আর সমুদ্রে ডুবে প্রাণ হারানোর শঙ্কা। ‘জলে কুমির ডাঙ্গায় বাঘ’ এর মতোই উভয় সংকটের মুখে এখন রোহিঙ্গাদের জীবন। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর অভিযানের হাত থেকে প্রাণে বাঁচতে সমুদ্র পথে মানবিক বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে কত জন প্রাণ হারিয়েছেন তার সঠিক কোন সঠিক পরিসংখ্যান নেই কারো কাছেই।
ছোট ছোট নৌকায় করে পালিয়ে আসতে প্রায়ই নৌকা উল্টে প্রাণ হারান রোহিঙ্গারা। অনেকের লাশ পাওয়া যায়, আবার অনেকের লাশ আর কখনোই পাওয়া যায় না। ফলে গণকবর কিংবা সমুদ্র সলিল হয়েই জীবনের করুণ পরিণতি ভোগ করেন রোহিঙ্গারা। একটি সূত্র মতে, নাফ নদী ও বঙ্গোপসাগরে এ পর্যন্ত ২৭টির বেশি নৌকাডুবির ঘটনা ঘটেছে।
এতে অন্তত ১৩৬ জন রোহিঙ্গার মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এর মধ্যে শিশু ৬৯ জন, নারী ৪৬ জন ও পুরুষ ২১ জন। আর জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে পাঁচ শতাধিক রোহিঙ্গাকে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে উখিয়ার ইনানী সমুদ্র সৈকতের কাছে রোহিঙ্গা বোঝাই নৌকা ডুবির ঘটনায় ২০ জনের মৃত্যু হয়েছে। নৌকাটিতে যাত্রী ছিল ৮০ জনের মত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) জানিয়েছিল, ওই ঘটনায় আরো ৪০ জন নিখোঁজ রয়েছে।
সমুদ্র পথে কিভাবে আসেন রোহিঙ্গারা? কেন ডুবে তাদের নৌকা?
রোহিঙ্গাদের অসহায়ত্বকে পুঁজি করে অনেকেই শুরু করেছেন ব্যবসা। সমুদ্র পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা জানিয়েছেন তাদের আসার জন্য জনপ্রতি গুনতে হয়েছে ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা করে। আর এ জন্য প্রথমেই তাদেরকে দালালদের শরণাপন্ন হতে হয়। দালালদের টাকা দিলে তারা পারাপারের জন্য মাছ ধরার নৌকা নিয়ে আসে। যারা টাকা দিতে পারে না, তারা মিয়ামারের নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে ধরা পরার ভয়ে পাহাড়ে-জঙ্গলে পালিয়ে বেড়ান। আর ধরা পড়লে হারাতে হয় প্রাণ।
ইঞ্জিন চালিত ছোট নৌকায় করে বাংলাদেশে আসতে ডুবে মরতে হয় রোহিঙ্গাদের। এর কারণ দালালদের বাড়তি লোভ। ৪০ জন ধারণ ক্ষমতা সম্পন্ন নৌকায় তারা অর্থের লোভে দ্বিগুণ যাত্রী তোলেন। ফলে সমুদ্রে বড় ঢেউ বা ঝড়ো বাতাস হলেই নৌকা উল্টে যায়। পরবর্তীতে তীরে ভেসে উঠতে শুরু করে একের পর এক নিথর দেহ। ছোট নৌকার অতিরিক্ত যাত্রী হয়ে যেন মৃত্যুপুরীর উদ্দেশ্যেই যাত্রা শুরু করেন হতভাগ্য এই রোহিঙ্গারা।
রোহিঙ্গাদের অর্থের বিনিময়ে পরাপার এবং নৌকায় তুলে মালামাল ছিনতাইসহ নারীদের নির্যাতনের অভিযোগে এর মধ্যে ২৩০ দালালকে ভ্রাম্যমাণ আদালত আটক করার পরেও এ ধরনের ঘটনা যেন থামছে না কিছুতেই। দালালদের এই দৌরাত্ম থামানো না গেলে এবং অতিরিক্ত যাত্রী বহন ফেরানো না গেলে নিহতের সংখ্যা আর দুর্ঘটনার হার কোনটাই কামানো যাবে না।
আর যারা সমুদ্র পথে ডুবতে ডুবতে বেঁচে গেছেন তারা এসে আশ্রয় নিয়েছেন শরণার্থী ক্যাম্পে। অনেক শিশু অন্যের পিতাকে দেখে নিজের পিতার কথা মনে করে অস্ফুট হাহাকারে হাত বাড়িয়েছেন ত্রানের জন্য। অনেক গর্ভবর্তী স্ত্রী তার পাশের অপর একজন নারীর স্বামীকে খাবার বহন করে নিতে দেখে নিজের স্বামীর কথা মনে করে নিঃশব্দে কাঁদছেন। এই মানুষগুলোর চোখের পানি মুছে দেওয়ার কেউ নেই। নিজের চোখের পানি নিজে মুছেই নিরাশার নিঃশ্বাস ত্যাগ করে অনিশ্চিত পৃথিবীর দিকে এগিয়ে চলছেন তারা।
একবিংশ শতাব্দির শুরুতেই এমন ভয়াবহ সংকট দেখেও বিশ্ব যখন চোখ বুজে বসে থাকে মানবতা তখন ডু্বে মরে নাফ নদে, বঙ্গোপসাগরে। আকাশ-বাতাস বিদীর্ণ করে কাঁদলেও সেই শব্দ জলীয় বাষ্পের মত মহাশূণ্যে ভেসে বেড়ায়। নিষ্ঠুর এই বিশ্ব যখন লাশের স্তূপের উপর স্বার্থের ব্যবসা খোঁজে তখন মানবতা হয় নির্মমতার বলি। রোহিঙ্গাদের লাশ হয় মুনাফার বিনোয়োগ। ধর্ম মন্দিরে মানুষের জীবন নয় প্রাণই বলি হয় বার বার। আর এই ধর্ম যখন অন্ধত্ব আর পরম হিংসা শেখায় তখন অধর্মই যেন বিজয়ের গান গায়।
লেখক: সাংবাদিক
This email address is being protected from spambots. You need JavaScript enabled to view it.
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর