আপনি পড়ছেন

আফগানিস্তানের পরিস্থিতি গত এক মাসে এত দ্রুত পাল্টেছে যে, তার সাথে তাল মিলিয়ে চলাটা আসলেই কঠিন ছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের শেষ মাসে এসে তালেবান যেন ২০ বছর আগের শক্তি দ্বিগুণ হারে ফেরত পেয়েছে। আগের চেয়ে অভিজ্ঞ, পরিপক্ক তালেবান বিজয়ের আনন্দে ভেসে যায়নি, এসেই সরকার গঠন করে পদ দখলে ব্যস্ত হয়ে পড়েনি। বরং সরকার গঠনে যেমন সময় নিচ্ছে, তেমনি আন্তর্জাতিক সম্পর্কগুলোও যাচাই করে নিচ্ছে। নতুন সরকারের স্বীকৃতি পেতে নিজেদের কাজকর্মে তারা যথেষ্ট সতর্কতাও অবলম্বন করছে।

afghanistan india and pakistanপাকিস্তান, আফগানিস্তান ও ভারতের তিন শীর্ষ নেতা

এ পরিস্থিতিতে প্রতিবেশী দুই দেশের প্রতিক্রিয়া নিয়ে স্বাভাবিকভাবেই বিশ্বে ব্যাপক কৌতুহল রয়েছে। দেশ দুটি হলো চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পাকিস্তান ও ভারত। তালেবানের আফগান পুনর্দখলে কারা লাভবান কিংবা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে- এ নিয়ে তুলনামূলক বিশ্লেষণ চলছে বিশ্বজুড়ে।

ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ, ভাষা ও সীমান্তের নৈকট্যসহ বিভিন্ন দিক দিয়ে পাকিস্তান বরাবরই আফগানিস্তানের অনেকটা কাছের। তবে সে নৈকট্য তো অন্য সরকারগুলোর সময়ও ছিল। তালেবান সরকারের ক্ষেত্রে তো বেশি কিছু নয়। আবার ভারত বিগত আফগান সরকারগুরোর সময় যে কূটনৈতিক ও বাণিজ্যিক সুবিধা আদায় করে নিয়েছিল, এখনো তো তা-ই করতে পারে।

gani baradaগুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় মোল্লা বারাদার ও তার সঙ্গীরা

বিষয়টি আসলে যত সহজ দেখা যাচ্ছে, আসলে ততটা নয়। কারণ গত বিশ বছরে আমেরিকার সাথে যুক্ত হয়ে ভারত আফগানিস্তানে ব্যাপক সুবিধা নিয়েছে। তারা কল্পনাই করতে পারেনি, ফের কখনো তালেবান কাবুলে পা রাখতে পারবে। ফলে তারা সরাসরিই তালেবানের বিরোধিতা করে গেছে। এমনকি আগের ওই অবস্থানের কারণে এখন পর্যন্ত তারা নিজেরাই তালেবানের ওপর আস্থা রাখতে পারছে না। তালেবান প্রতিনিধিরা আশ্বস্ত করা সত্ত্বেও।

অথচ গত দুই দশকে ভারত দেশটিতে প্রচুর বিনিয়োগ করেছে। রেমিট্যান্স আয়ের মাধ্যম হিসেবেও আফগানিস্তান তাদের কাছে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। কিন্তু নিজেদের অতীত ভুমিকার কারণে তারা এ দুটো ক্ষেত্র নিয়েও এখন পর্যন্ত কোনো কিছুই বলেনি। আফগানিস্তানে দৃশ্যত এখন আর তালেবানের অবস্থা নড়বড়ে নয়। এমন কোনো পক্ষও নেই, যারা তালেবানকে এ মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ করতে পারবে। পাঞ্জশিরের কিছু এলাকা তালেবানের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকলেও পুরো দেশের বিবেচনায় সেটি তেমন কিছুই নয়। আবার বৈশ্বিক কোনো শক্তিও এ পর্যন্ত তালেবানকে অন্তত ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদের কোনো চ্যালেঞ্জ করেনি। এমন অবস্থায় ভারতের বর্তমান পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর ‘ওয়েট অ্যান্ড সি’ ফর্মুলা গ্রহণের কথা বললেও আসলে এখানে অপেক্ষা করা বা দেখার কোনো কিছুই নেই।

বরং ভারতেরই কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, আফগানিস্তানকে পড়তে ভারত ভুল করেছে। আর পাকিস্তান সে সুবিধা নিয়ে নিজেদেরকে তালেবানের অন্যতম ঘনিষ্ঠ মিত্র ও সুহৃদ প্রমাণ করেছে। অথচ গত দুই সপ্তাহ বা এর আগেও পাকিস্তান তালেবানের সাথে তেমন কোনো মাখামাখি দেখায়নি। যে কোনো শর্তে তালেবানের সাথে আছি, এমন মনোভাবও দেখায়নি। বরং পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান প্রজ্ঞাপূর্ণ ভাষায় বলেছেন, সেখানকার জনগন যাদের ওপর আস্থা রাখবে, আমরা তাদের সাথেই কাজ করবো। আফগানিস্তানে আমাদের নিজস্ব কোনো পছন্দ নেই।

তালেবান কাবুল দখলের পর তিনি তাদেরকে অন্তর্ভুক্তিমূলক সরকার গঠনের পরামর্শ দিয়েছিলেন। তালেবানরাও সে পথেই এগোচ্ছে। আবার আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে যাওয়া শরণার্থীদেরও স্থান করে দিচ্ছে তারা। ফলে সব দিক দিয়েই দ্বিধামুক্তভাবে হাসিমুখেই এগিয়ে যাচ্ছে তারা। অন্যদিকে দ্বিধায় জড়িয়ে গেছে ভারতের পা, ভর করেছে হতাশা।

নিজেদের ভুল মেনে নিয়ে ভারতীয় ভাষ্যকাররা স্বীকার করেছেন, আফগান পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তানের অবস্থান সঠিক ছিল। ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব নিরুপমা মেনন রাও মন্তব্য করেন, ২০ বছর ধরে আমরা আফগানিস্তানে যা করেছি তা বিপদে পড়ে গেছে। আমরা বাসে উঠেছিলাম, কিন্তু সেটা ছিল চাকাবিহীন বাস। ইতিহাস কিভাবে আমাদের বিচার করবে? এবং এক্ষেত্রে পাকিস্তানই শেষ হাসি হাসছে।

অবসরপ্রাপ্ত ভারতীয় লেফটেন্যান্ট জেনারেল এইচ এস পানাগ লিখেছেন, ‘ভারত আফগানিস্তানে ভুল ঘোড়াকে সমর্থন দিয়ে গেছে। এর ফলে এখন কৌশলগতভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।'

ভারতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক প্রবীণ সাওহনি এক টুইটে বলেন, আমি আগেও বলেছি, পাকিস্তানের সাথে শান্তি এবং চীনের সহযোগিতা ছাড়া আফগানিস্তানে ভারত কোনো ভূমিকা রাখতে পারবে না। একটি সীমার পর রাশিয়াও আমাদের সাহায্য করতে পারবে না। এদিকে তালেবানের আগমনের সাথে সাথে পাকিস্তানের ভূ-রাজনৈতিক মর্যাদা অনেকখানি বেড়েছে। এর ফলে কাশ্মিরের ওপর তাদের অবস্থান কঠোর হবে।

ভারতীয় বিশ্লেষকরা বলেন, ভারত অন্য সবাইকে উপেক্ষা করে যুক্তরাষ্ট্রের ওপর নির্ভর করছিল। পরে যদিও ভারত আফগান তালেবানের কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছিল, কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে যায়। এর ফলে ভারত গত ২০ বছরে আফগানিস্তানে যে বিপুল বিনিয়োগ করেছে সেগুলোর সবই এখন শঙ্কার মুখে আছে।

এর মধ্যে আরেকটি বিপদে পড়ে গেছে ভারত। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে দেশটি। আর এ সময়ে নিশ্চিতভাবেই আফগানিস্তানের ইস্যুটি বারবার উঠে আসছে। সেখানে আফগানিস্তানের ব্যাপারে নিজেদের মত খুব বেশি চাউর করা যাচ্ছে না। নিরাপত্তা পরিষদের প্রায় সব দেশই এখন আর তালেবানকে উচ্ছেদ করার পক্ষে নয়। বরং সময় নিয়ে তাদের কার্যক্রম দেখার পক্ষে। যার দরুন সভাপতির দায়িত্ব পালনটা কঠিনই হয়ে পড়ছে ভারতের জন্য।

এখন যে প্রশ্নটি সবচেয়ে বেশি চর্চিত হচ্ছে, তা হল: আফগানিস্তানে ভারতের জন্য কী বিকল্প রয়েছে? উত্তরে বলা হচ্ছে, খুব বেশি বিকল্প ভারতের হাতে নেই। প্রথম বিকল্প হল আফগান তালেবানকে স্বীকৃতি দেয়া এবং নতুন বাস্তবতা মেনে নেয়া। কিন্তু তালেবানের বিরুদ্ধে ভারত আগে থেকেই যে অবস্থান নিয়েছে, তাতে এ কাজটি কঠিনই হবে নয়া দিল্লির জন্য।

অন্য যে বিকল্প আছে তা হলো, আমেরিকা ও অন্যান্য দেশের সাথে অ-পশতুন গোষ্ঠী যেমন আহমদ মাসুদ, উত্তর জোটের নেতা আহমেদ শাহ মেহসুদের ছেলে এবং আমরুল্লাহ সালেহদের সমর্থন করা। তবে এতে বিপদ আছে, কারণ ইরান ও রাশিয়ার মতো দেশগুলো, যারা অতীতে উত্তর জোটকে সমর্থন করেছিল, তারা এ দফায় তালেবানের সাথে কাজ করার দিকে ঝুঁকছে।

ফলে সব কিছু মিলিয়েও মুখে হতাশার চিহ্ন কাটিয়ে হাসি ফেরানোর মতো কোনো পথ পাচ্ছে না ভারত।

সূত্র: এক্সপ্রেস ট্রিবিউন

প্রিয় পাঠক, ভিন্নমতে প্রকাশিত লেখার বিষয়বস্তু, রচনারীতি ও ভাবনার দায় একান্ত লেখকের। এ বিষয়ে টোয়েন্টিফোর লাইভ নিউজপেপার কোনোভাবে দায়বদ্ধ নয়। ধন্যবাদ।

গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...

খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর