ভারতের হরিয়ানায় মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের ডাক!

ভারতের হরিয়ানায় একটি পঞ্চায়েত সভা থেকে মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানানো হয়েছে। ‘সমস্ত হিন্দু সমাজ’-এর ব্যানারে এ পঞ্চায়েতে বজরঙ দল, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, গো রক্ষা দলসহ কয়েকটি সংগঠনের নেতারা বক্তব্য রাখেন। পঞ্চায়েতের আয়োজকরা মুসলমানদের অবৈধ অভিবাসী আখ্যা দিয়ে এক সপ্তাহের মধ্যে মানেসার থেকে বহিষ্কারের জন্য ডিসির কাছে স্মারকলিপি দেন। ডিউটি ম্যাজিস্ট্রেট সজ্জন সিং স্মারকলিপি গ্রহণ করেন। খবর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস ও দ্য কুইন্ট। 

মানেসার ছাড়াও গুরগাঁও, কাসান ও আশেপাশের এলাকা থেকে মানুষ পঞ্চায়েতে যোগ দেন

স্মারকলিপিতে বলা হয়, মানেসারে মুসলিম অবৈধ অভিবাসীরা বসবাস করছে। এ বিষয়ে অবিলম্বে তদন্ত করা জরুরি। যারা অবৈধভাবে বসবাস করছে তাদের বহিষ্কার করতে হবে। তারা মানুষকে ধর্মান্তরিত করছে। আমরা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাই। এক সপ্তাহের মধ্যে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া না হলে আমরা আরও বড় সমাবেশ করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেব।

পঞ্চায়েতের অন্যতম বক্তা ও বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মানেসার শাখার সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্র সিং বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত তদন্তপূর্বক তাদের বহিষ্কার করা। প্রশাসন যদি অবৈধ মানুষদের বহিষ্কার না করে, তাহলে হিন্দুরা নিজেরাই এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবে।

তিনি অভিযোগ করেন, অনেক রোহিঙ্গা, বাংলাদেশি ও পাকিস্তানি নিজেদের পরিচয় গোপন করে অবৈধভাবে মানেসার ও গুরগাঁওয়ে বসবাস করছে। তারা বিভিন্ন খাতে ব্যবসা চালু করেছে। এসব মুসলমানের দোকানপাট ব্যবসার জন্য নয়। এরা আদতে ধর্মীয় যুদ্ধ পরিচালনা করছে।

দিল্লি থেকে ৫০ কিলোমিটারেরও কম দূরত্বের শহর মানেসারে রোববার এ পঞ্চায়েত অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় ২০০ মানুষ পঞ্চায়েতে উপস্থিত ছিলেন। মানেসার ছাড়াও কাসান, ধারুহেরা ও গুরগাঁও থেকে মানুষ এ পঞ্চায়েতে যোগ দেন। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম গতকাল ও আজ এ পঞ্চায়েতের খবর ছেপেছে।

জানা গেছে, মানেসার এলাকায় কোনো মুসলিম বসবাস করে কিনা সে বিষয়ে নজরদারি করতে এবং মুসলমানবিরোধী বয়কট কার্যকর করতে প্রতিটি গ্রামে কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পঞ্চায়েত। একইসঙ্গে পঞ্চায়েত মহানবী (স.) সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্যের জন্য বিজেপির সাবেক মুখপাত্র নূপুর শর্মাকে জাতির কাছে ক্ষমা চাইতে বলায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি সূর্য কান্ত ও বিচারপতি জেবি পারদিওয়ালাকে অভিসংশনের আহ্বান জানিয়েছে।

বক্তারা মুসলিম মালিকানাধীন দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে কোনো ধরনের পণ্য ও সেবা না কিনতে এবং মুসলমানদের কাছে বাসাবাড়ি-দোকান ভাড়া না দিতে সবার প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। একইসঙ্গে তারা পকেটে মোবাইল না রেখে অস্ত্র রাখার আহ্বান জানিয়েছেন। স্থানীয় অধিবাসীদের উদ্দেশে তারা বলেন, মোবাইল ফোন আপনাকে রক্ষা করবে না। কিন্তু অস্ত্র আপনাকে জিহাদিদের হাত থেকে বাঁচাবে।

পঞ্চায়েত সদস্য আশুতোষ ত্যাগী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, হিন্দুত্বর জন্য, নিজের ধর্মের জন্য গুলি ছুঁড়তে হলে আশুতোষ ত্যাগী সবার আগে থাকবে।

মনীশ শর্মা নামে এক বক্তা বলেন, মুসলমানদের কাছ থেকে কোনো পণ্য ও সেবা না কিনতে আমাদের শপথ করতে হবে। তাদের কাছ থেকে ফল, শরবত কিছু কেনা যাবে না। তাদের দোকানে চুল কাটতে যাওয়া যাবে না। তাদেরকে সম্পূর্ণভাবে বয়কট করতে হবে। হালাল সার্টিফিকেট থাকলে সে পণ্য বয়কট করতে হবে।

ভারতের মানবাধিকার ও রাজনৈতিক কর্মীরা পঞ্চায়েতে বক্তব্যের ভিডিও ফুটেজ সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে অভিযোগ তুলছেন, পুলিশের উপস্থিতিতে এমন সাম্প্রদায়িক আয়োজন ও উসকানিমূলক বক্তব্য রাখা হলেও কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

এ ধরনের সমাবেশের আগে পুলিশের অনুমতি নেওয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে মানেসার থানার স্টেশন হেড অফিসার বিজয় কুমান ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসকে বলেন, পঞ্চায়েত হবে বলে আমরা খবর পেয়েছিলাম। সতর্কতামুলক ব্যবস্থা হিসেবে থানা থেকে সেখানে পুলিশ সদস্যদের পাঠানো হয়েছিল। সমাবেশটি শান্তিপূর্ণ ছিল।

পঞ্চায়েতে অংশগহণকারীদের একজন সংবাদ পোর্টাল দ্য কুইন্টকে বলেছেন, আমি এমনকি চুল কাটতেও মুসলিম নাপিতের কাছে যাই না। কখনো বাইরে খেতে হলে আমি হিন্দু মালিকানাধীন হোটেল-রেস্তোরাঁ খুঁজি। আইডি দেখার চেষ্টা করি। আমাদের সব ভাইয়ের উচিত এ ব্যাপারে সচেতন হওয়া ও তাদেরকে বয়কট করা। ব্যবসা না চললে ওরা নিজেরাই এখান থেকে পালাবে।

এতে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের মানেসার জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক দেবেন্দ্র সিং, বিশ্ব হিন্দু পরিষদের যুব মিলিশিয়া বজরং দলের নেতা মনু মানেসার, গো রক্ষা দলের নেতা ধর্মেন্দ্র মানেসার প্রমুখ।

এর আগে নয়াদিল্লির বুরারি, হরিয়ানার নুহ, উত্তরাখণ্ডের রুরকি ও উত্তর প্রদেশের প্রজ্ঞারাজে (এলাহাবাদ) একইরকম পঞ্চায়েত থেকে মুসলমানদের অর্থনৈতিকভাবে বয়কটের আহ্বান জানানো হয়। ভারতের বিভিন্ন শহরে মুসলিম ব্যবসায়ীদের দোকান ও প্রতিষ্ঠানে জঙ্গি হিন্দুত্ববাদী গ্রুপের সদস্যদের হামলার খবরও সংবাদমাধ্যমে এসেছে।

চলতি বছরের গোড়ার দিকে বিজেপি-শাসিত কর্নাটক রাজ্য সরকার সেখানকার মন্দিরগুলোর আঙ্গিনা ও আশেপাশে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাইরের কেউ ব্যবসা করতে পারবে না বলে রাজ্য বিধানসভায় ঘোষণা দেয়। এরপর কর্নাটক, উত্তরপ্রদেশ, মধ্যপ্রদেশসহ কয়েকটি রাজ্যে মন্দির ছাড়াও বিভিন্ন মেলা ও উৎসবে মুসলমানদের স্টল নিতে বাধা দেওয়া হয়। কয়েকটি আবাসিক এলাকা ও গ্রামে মুসলিম ফেরিওয়ালা, হকারদের বেদম মারধরের ঘটনা ঘটে।