মার্কিন শুল্কের চাপ: দর-কষাকষির টেবিলে বাংলাদেশ, বিকল্প পথের সন্ধান
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
বাংলাদেশের উৎপাদন খাতে গভীর অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ থেকে আমদানিকৃত সকল পণ্যের ওপর ৩৫ শতাংশ শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছে, যা ২০২৫ সালের ১ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।

এই সিদ্ধান্তটি বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে পাঠানো মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের একটি চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে। এটিকে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক উত্তেজনার একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হিসেবে দেখা হচ্ছে এবং এর ফলে বাংলাদেশের শক্তিশালী রপ্তানি খাত, বিশেষ করে অতীব গুরুত্বপূর্ণ তৈরি পোশাক শিল্পে মারাত্মক প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
পূর্বে প্রস্তাবিত ৩৭ শতাংশ শুল্ক থেকে সামান্য কমানো হলেও, এই নতুন ৩৫ শতাংশ শুল্ক অতীতের গড় ১৫ শতাংশ হারের চেয়ে অনেক বেশি। এর ফলে বাংলাদেশের প্রধান আঞ্চলিক প্রতিযোগী ভিয়েতনামের তুলনায় দেশটি বেশ অসুবিধাজনক অবস্থানে পড়বে। ভিয়েতনামকে অপেক্ষাকৃত কম, অর্থাৎ ২০ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হতে হবে বলে জানা গেছে।
প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসকে পাঠানো চিঠিতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আরও বলেছেন যে, এই নতুন হার ‘খাতভিত্তিক সকল শুল্কের বাইরে’ ধার্য হবে। এর অর্থ হলো, মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য তৈরি পোশাক খাতকে কার্যকরভাবে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত শুল্কের সম্মুখীন হতে হতে পারে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প, যা দেশের মোট রপ্তানির ৮০ শতাংশের বেশি এবং মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৮ শতাংশ জোগান দেয়, এই পদক্ষেপে সবচেয়ে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে অনুমান করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি গন্তব্য, যেখানে দেশটি বার্ষিক প্রায় ৮০০ কোটি ডলারের বাংলাদেশি পণ্য আমদানি করে, যার মধ্যে ৬০০ কোটি ডলারের বেশি হলো পোশাক। এই বর্ধিত শুল্ক মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি বস্ত্রের দাম নাটকীয়ভাবে বাড়িয়ে দেবে।
বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এর ফলে চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেতে পারে, কারখানায় উৎপাদন কমে যেতে পারে এবং এই খাতে কর্মরত আনুমানিক ৪০ লক্ষ মানুষের ব্যাপক কর্মচ্যুতি ঘটতে পারে।
মুডি’স অ্যানালিটিকসের পরিচালক এবং এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অর্থনীতি বিভাগের প্রধান ক্যাটরিনা এল বলেছেন, ‘এটি ধ্বংসাত্মক হবে’। তিনি উল্লেখ করেন, বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হয়।
এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকার কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করেছে। বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন ওয়াশিংটন ডি.সি.-তে মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির সঙ্গে আলোচনায় নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে থাকা ৬০০ কোটি ডলারের বেশি বাণিজ্য উদ্বৃত্ত কমাতে বেশ কিছু ছাড়ের প্রস্তাব দিয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে গম, তুলা, তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) এবং সয়াবিনের মতো মার্কিন পণ্য শুল্কমুক্ত আমদানির সুবিধা।
এদিকে, তৈরি পোশাক রপ্তানিতে যুক্তরাষ্ট্রের সম্ভাব্য শুল্ক বৃদ্ধির বিষয়ে সরকারের অগ্রগতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক ও রপ্তানিকারক সমিতি (বিজিএমইএ) যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্য নীতিতে প্রভাব বিস্তারের জন্য তদবিরকারী সংস্থা বা লবিস্ট নিয়োগের উদ্যোগ নিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি মাহমুদ হাসান খান বলেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত লাভজনক একটি বাজার, তাই শুল্ককে একটি যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার জন্য সরকারকে সমন্বিত প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
বিজিএমইএ-এর লক্ষ্য হলো মার্কিন বাণিজ্য নীতিকে প্রভাবিত করা এবং মার্কিন বাজারে বাংলাদেশি পোশাক নির্মাতাদের স্বার্থ রক্ষা করা। তিনি আরও জানান, তদবিরকারী সংস্থা নিয়োগ একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া এবং এর জন্য সময় প্রয়োজন। সরকার ইতোমধ্যে মার্কিন তুলার রপ্তানিকারকদের জন্য বন্ডেড ওয়্যারহাউস বা শুল্কমুক্ত সংরক্ষণাগার সুবিধাসহ আকর্ষণীয় কিছু প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
বিজিএমইএ সভাপতি বলেন, ‘শুল্ক কমানো বা নতুন শুল্ক আরোপের জন্য সময় বাড়ানোর বিষয়টি সম্পূর্ণ মার্কিন প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করছে। তাই শুল্ক কমানোর জন্য আমাদের আরও অনেক কিছু করতে হবে, অন্যথায় বিকল্প পথই শ্রেয়।’
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন ইউএনবিকে বলেন, মার্কিন বাজারে প্রবেশের জন্য আরোপিত শুল্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কিছু দেশের চেয়ে এগিয়ে থাকবে, আবার কিছু দেশের চেয়ে পিছিয়ে থাকবে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু বিষয়টি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশের মধ্যে আলোচনা চলছে এবং অন্যান্য দেশের জন্য শুল্ক এখনো চূড়ান্ত হয়নি, তাই সার্বিকভাবে আমাদের অবস্থান কী হবে, তা জানতে আরও কিছু সময় লাগবে।’
তিনি মত দেন, ‘যদি বাংলাদেশকে ৩৫ শতাংশ শুল্কের সম্মুখীন হতে হয় এবং ভারত, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা কম শুল্কের সুবিধা পায়, তাহলে আমরা মার্কিন বাজারে আমাদের বর্তমান রপ্তানির প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত হারাতে পারি।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ মুস্তাফা কে. মুজেরি বলেছেন, মার্কিন পণ্যের শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার দেওয়ার চেয়ে উৎপাদন খাতে দেশের অভিযোজন ক্ষমতা বাড়ানোর ওপর অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান বাণিজ্য নীতি অস্থিতিশীল, কারণ এটি ক্রমাগত বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) নির্ধারিত বাণিজ্য নিয়ম লঙ্ঘন করছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, বাংলাদেশকে সেইসব মার্কিন ক্রেতাদের প্রভাবিত করতে হবে, যারা এদেশের পোশাক খাতের ওপর ভিত্তি করে তাদের শত শত কোটি ডলারের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। তিনি যুক্তরাষ্ট্র থেকে অতিরিক্ত ও অপ্রয়োজনীয় আমদানির বিরোধিতা করে বলেন, এটি অর্থনৈতিকভাবে অত্যন্ত ব্যয়বহুল হবে। বরং মার্কিন ক্রেতা ও কৃষকরা বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে পারেন, কারণ তাদের পণ্য (তুলা) পোশাক খাতে ব্যবহৃত হয়।
আপাতদৃষ্টিতে বাংলাদেশের রপ্তানি অর্থনীতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। যদিও কিছু শীর্ষ রপ্তানিকারক মনে করছেন যে ৩৫ শতাংশের অঙ্কটি দর-কষাকষির একটি কৌশল এবং শেষ পর্যন্ত এটি কমানো হবে, অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করছেন যে চূড়ান্ত ফলাফল চীন, ভারত ও পাকিস্তানের মতো অন্যান্য প্রধান পোশাক রপ্তানিকারকদের ওপর আরোপিত শুল্কের ওপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশের জন্য এই শুল্ক একটি জরুরি সতর্কবার্তা হিসেবে কাজ করছে। এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র-নির্ভরতা কমিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়ার মতো অঞ্চলে নতুন বাজার অনুসন্ধান এবং রপ্তানি বৈচিত্র্য আনার প্রয়োজনীয়তা স্পষ্ট হয়েছে। শিল্প বিশেষজ্ঞরা উচ্চমূল্য সংযোজিত পণ্য উৎপাদনে মনোযোগ দেওয়া, শক্তিশালী সরকার-টু-সরকার কূটনীতির মাধ্যমে বাণিজ্য সম্পর্ক জোরদার করা এবং আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের আকৃষ্ট ও ধরে রাখতে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করারও আহ্বান জানিয়েছেন। এই জটিল বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিস্থিতিতে কৌশলগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ওপরই এখন সবকিছু নির্ভর করছে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.