মেঘভাঙা বৃষ্টি আসলে কী এবং কেন এত বিধ্বংসী?
- Details
- by আন্তর্জাতিক ডেস্ক
সম্প্রতি ভারতের উত্তরাখণ্ডে ঘটে যাওয়া বিপর্যয় আবারও ‘মেঘভাঙা বৃষ্টি’ বা ‘ক্লাউডবার্স্ট’ শব্দটিকে আলোচনার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। সাধারণ বৃষ্টির সঙ্গে এর পার্থক্য কী? কেন এটি এত অল্প সময়ে এমন ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞ ঘটাতে পারে? এর পেছনের বিজ্ঞান এবং বিধ্বংসী হওয়ার কারণগুলো নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।

মেঘভাঙা বৃষ্টি (ক্লাউডবার্স্ট) কী?
সহজ কথায়, মেঘভাঙা বৃষ্টি হলো অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে একটি ছোট ও নির্দিষ্ট এলাকায় অস্বাভাবিক পরিমাণে বৃষ্টিপাত।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংজ্ঞা অনুযায়ী, যখন এক থেকে দশ বর্গকিলোমিটারের মতো একটি ছোট ভৌগোলিক এলাকায় এক ঘণ্টায় ১০০ মিলিমিটার (বা ১০ সেন্টিমিটার) বা তারও বেশি বৃষ্টিপাত হয়, তখন সেই চরম আবহাওয়ার ঘটনাকে মেঘভাঙা বৃষ্টি বা ক্লাউডবার্স্ট বলা হয়।
এর সঙ্গে সাধারণ ভারী বৃষ্টির মূল পার্থক্য হলো এর তীব্রতা এবং স্থানিক সীমাবদ্ধতা। এটি আক্ষরিক অর্থে মেঘের ‘ফেটে পড়া’ বা কোনো ‘বিস্ফোরণ’ নয়, বরং এটি একটি নির্দিষ্ট স্থানে মেঘের ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত জল অতি দ্রুত ঝরে পড়ার একটি প্রক্রিয়া। এর প্রভাব সাধারণ বৃষ্টির চেয়ে বহুগুণ বেশি বিধ্বংসী হতে পারে।
কেন মেঘভাঙা বৃষ্টির ঘটনা ঘটে?
মেঘভাঙা বৃষ্টির পেছনের মূল কারণ হলো উষ্ণ ও আর্দ্র বাতাসের দ্রুত ঘনীভবন। প্রক্রিয়াটি কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়:
১. উষ্ণ ও আর্দ্র বায়ুর সঞ্চালন: যখন প্রচুর জলীয় বাষ্পসহ উষ্ণ বাতাস কোনো একটি অঞ্চলের দিকে প্রবাহিত হয়, তখন মেঘভাঙা বৃষ্টির পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। ভারতে বর্ষা মৌসুমে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমি বায়ু এই ধরনের আর্দ্রতা বয়ে আনে।
২. ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’ ও পার্বত্য বাধা: পার্বত্য অঞ্চলে মেঘভাঙার ঘটনা বেশি ঘটে। এর প্রধান কারণ হলো পাহাড়ের ভৌগোলিক গঠন। আর্দ্র বাতাস যখন পর্বতের পথে বাধা পায়, তখন তা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে উপরের দিকে উঠতে বাধ্য হয়। এই প্রক্রিয়াকে বিজ্ঞানের ভাষায় ‘অরোগ্রাফিক লিফ্ট’ বলা হয়।
৩. দ্রুত শীতলীকরণ ও ঘনীভবন: বাতাস যত উপরে উঠতে থাকে, তত প্রসারিত ও শীতল হয়। শীতল বাতাসের জলীয় বাষ্প ধারণের ক্ষমতা কম। ফলে বাতাসের জলীয় বাষ্প দ্রুত ঘনীভূত হয়ে জলকণায় পরিণত হয় এবং মেঘ তৈরি করে।
৪. জলকণা আটকে থাকা: উষ্ণ বাতাসের শক্তিশালী ঊর্ধ্বমুখী স্রোত এই জলকণাগুলোকে বৃষ্টি হিসেবে ঝরে পড়তে দেয় না, বরং সেগুলোকে মেঘের মধ্যেই আটকে রাখে। এর ফলে অল্প জায়গায় বিপুল পরিমাণ জলকণা জমা হয়ে একটি বিশাল জলভাণ্ডার তৈরি হয়।
৫. আকস্মিক বৃষ্টিপাত: এক পর্যায়ে, যখন মেঘের মধ্যে জমা হওয়া জলের পরিমাণ এতটাই বেড়ে যায় যে ঊর্ধ্বমুখী বায়ুস্রোত আর তাকে ধরে রাখতে পারে না, তখন সম্পূর্ণ জলরাশি প্রায় একসঙ্গে তীব্র গতিতে নিচে নেমে আসে। এর ফলেই সৃষ্টি হয় মেঘভাঙা বৃষ্টি।
মেঘভাঙা বৃষ্টি কেন এত বিধ্বংসী?
শুধুমাত্র জলের পরিমাণ নয়, মেঘভাঙা বৃষ্টির বিধ্বংসী ক্ষমতার পেছনে একাধিক কারণ জড়িত।
তীব্র গতি: পার্বত্য অঞ্চলে খাড়া ঢালের কারণে বিপুল পরিমাণ জল অত্যন্ত দ্রুতগতিতে নিচের দিকে ধেয়ে আসে। এই জলের স্রোত এতটাই শক্তিশালী হয় যে তার গতিপথে থাকা যেকোনো কিছুই ভাসিয়ে নিয়ে যেতে পারে।
আকস্মিক বন্যা: অল্প সময়ে বিপুল পরিমাণ জল মাটিতে শোষিত হওয়ার সুযোগ পায় না। ফলে সমস্ত জলরাশি তীব্র বেগে নদী বা নিচু এলাকার দিকে প্রবাহিত হয়ে আকস্মিক বন্যার সৃষ্টি করে, যা সাধারণ বন্যার চেয়ে অনেক বেশি ধ্বংসাত্মক।
কাদা ও পাথরের স্রোত: পাহাড়ের ওপর থেকে নামার সময় এই জলের স্রোত তার সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে কাদা, বালি, বড় বড় পাথর (বোল্ডার) এবং ধ্বংসাবশেষ বহন করে আনে। এই মিশ্রণ একটি কংক্রিটের স্রোতের মতো শক্তিশালী হয়ে ওঠে, যা ঘরবাড়ি, সেতু, রাস্তাঘাট—সবকিছু ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। উত্তরাখণ্ডের ধরালি গ্রামে ঠিক এমনটাই ঘটেছে।
ভূমিধস: বিপুল পরিমাণ জল মাটিকে নরম ও অস্থিতিশীল করে তোলে, যার ফলে বড় ধরনের ভূমিধসের ঘটনা ঘটে। এতে ক্ষয়ক্ষতির মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়।
মানব সৃষ্ট কারণ: পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, এই বিপর্যয়ের তীব্রতা বাড়ার পেছনে মানবসৃষ্ট কারণও দায়ী। পার্বত্য অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগরায়ণ, রাস্তাঘাট ও বাঁধ নির্মাণ, নির্বিচারে বনভূমি ধ্বংস করার ফলে মাটির জলধারণ ক্ষমতা হ্রাস পেয়েছে এবং প্রাকৃতিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ফলে বৃষ্টির জল সহজে প্রবাহিত হতে না পেরে ধ্বংসযজ্ঞের তীব্রতা বাড়িয়েছে।
পূর্বাভাস দেওয়ার অসুবিধা: মেঘভাঙার ঘটনাগুলো অত্যন্ত স্থানীয় এবং আকস্মিক হওয়ায় এর নির্দিষ্ট পূর্বাভাস দেওয়া প্রায় অসম্ভব। আবহাওয়া দপ্তর কোনো বড় অঞ্চলে ভারী বৃষ্টির সতর্কতা দিতে পারলেও, ঠিক কোন পাহাড়ে বা কোন উপত্যকায় মেঘ ভাঙবে তা নির্দিষ্ট করে বলা কঠিন। এর জন্য অত্যন্ত উন্নত ও ঘন রাডার নেটওয়ার্ক প্রয়োজন, যা অনেক দুর্গম অঞ্চলে নেই।
সব মিলিয়ে, মেঘভাঙা বৃষ্টি শুধু একটি প্রাকৃতিক ঘটনাই নয়; এর সঙ্গে ভৌগোলিক অবস্থান, পরিবেশগত পরিবর্তন এবং মানবসৃষ্ট কার্যকলাপের একটি জটিল সম্পর্ক রয়েছে, যা একে এক ভয়ঙ্কর প্রাকৃতিক দুর্যোগে পরিণত করেছে।
গুগল নিউজে আমাদের প্রকাশিত খবর পেতে এখানে ক্লিক করুন...
খেলাধুলা, তথ্য-প্রযুক্তি, লাইফস্টাইল, দেশ-বিদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষণ সহ সর্বশেষ খবর
Stay up-to-date with the latest news from Bangladesh. Our comprehensive coverage includes politics, business, sports, and culture. Get breaking news, analysis, and commentary on the issues that matter most to Bangladeshis and the international community.
Bangladesh is a country located in South Asia and is home to a diverse population of over 160 million people. It has a rich cultural heritage and a rapidly growing economy. News from Bangladesh covers a wide range of topics, including politics, economics, social issues, culture, and more. The country has made significant progress in recent years in areas such as poverty reduction, education, and healthcare. However, it still faces challenges such as corruption and environmental degradation. Bangladeshi news sources cover both local and international news to keep the public informed about the latest developments and events.