পাকিস্তানে প্রলয়ংকরী বন্যা: একদিনে ১৮৫ জনের মৃত্যু

পাকিস্তানে আকস্মিক বন্যায় একদিনেই অন্তত ১৮৫ জনের মৃত্যু হয়েছে। শুক্রবার দেশটির জাতীয় কর্মকর্তারা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। বিধ্বংসী বর্ষা মৌসুমের সঙ্গে লড়াইরত দক্ষিণ এশিয়ার এই দেশটিতে এবারের গ্রীষ্মে মৃতের সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েই চলেছে।

শুক্রবার অধিকাংশ মৃত্যুই ঘটেছে উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে, যেখানে অন্তত ১৭১ জন প্রাণ হারিয়েছেন। প্রাদেশিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র বুনার জেলাতেই ৭৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বাড়িঘর ধসে পড়া এবং বন্যার পানির তীব্র স্রোতে মানুষ ভেসে যাওয়ার কারণে এই প্রাণহানি ঘটেছে।

উদ্ধারকারী দলগুলো আকাশপথে, পায়ে হেঁটে এবং মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক ব্যবহার করে বন্যা কবলিত এলাকায় পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। তবে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাওয়ার পথে একটি হেলিকপ্টার খারাপ আবহাওয়ার কারণে বিধ্বস্ত হয়, এতে পাঁচজন ক্রু সদস্য নিহত হন।

বুনার থেকে নির্বাচিত পাকিস্তানের সংসদ সদস্য গোহর খান জিও টিভিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘পুরো গ্রাম ধ্বংস হয়ে গেছে। রাস্তাঘাট সব ভেসে গেছে’।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনের ফলে সৃষ্ট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান তীব্র তাপপ্রবাহের সম্মুখীন হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে করাচির মতো বড় শহরগুলোতে তীব্র দাবদাহ, বর্ষা মৌসুমে অস্বাভাবিক মাত্রার প্রবল বৃষ্টি এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমবাহ গলে সৃষ্ট আকস্মিক বন্যা।

জাতীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার মতে, চলতি বছরের জুন মাসের শেষের দিকে বর্ষা মৌসুম শুরু হওয়ার পর থেকে পাকিস্তানজুড়ে বৃষ্টি-সম্পর্কিত ঘটনায় অন্তত ৪৯৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। এছাড়া আহত হয়েছেন আরও ৭ শতাধিক মানুষ।

শুক্রবার উত্তর পাকিস্তানের বিভিন্ন অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের সঙ্গে কর্দমাক্ত স্রোত দোকানপাট, ঘরবাড়ি এবং তীর্থস্থানগুলোতে ঢুকে পড়ে। কিছু মসজিদের লাউডস্পিকারে ইমামরা সাহায্যের জন্য ঐশ্বরিক সহায়তা কামনা করেন এবং বাসিন্দাদের সুরক্ষার জন্য প্রার্থনা করার আহ্বান জানান।

বুনার জেলার একটি বাজারের ব্যবসায়ী সৈয়দ মেহমুদ বাচাহ নিজের ক্ষতির কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমার যা কিছু ছিল—মুদি মাল, খাবার জিনিসপত্র—সবই ধ্বংস হয়ে গেছে। আমি কিছুই বাঁচাতে পারিনি।’ তিনি জানান, তার ক্ষতির পরিমাণ হাজার হাজার ডলার।

প্রতিবেশী গিলগিট-বালতিস্তান অঞ্চলে আরও অন্তত ১০ জন বন্যার পানিতে ভেসে গেছেন বলে জানিয়েছেন আঞ্চলিক সরকারের মুখপাত্র ফাইয়াজুল্লাহ ফারাক।

কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আগামী আরও কয়েক দিন দেশের বিস্তীর্ণ অংশে ভারী বৃষ্টিপাতের আশঙ্কা করা হচ্ছে। ফলে মৃতের সংখ্যা আরও উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়তে পারে বলে তারা উল্লেখ করেছেন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পাকিস্তানে বর্ষা মৌসুম আরও ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। ২০২২ সালের বন্যায় ১,৭০০ জনেরও বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল, যা ছিল সাম্প্রতিক সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগগুলোর একটি। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, সে সময় পাকিস্তানের এক-তৃতীয়াংশ ডুবে গিয়েছিল এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল ৩০ বিলিয়ন ডলারের বেশি।

এই বছর ভারী বৃষ্টি পাকিস্তানের সবচেয়ে জনবহুল প্রদেশ পাঞ্জাব, রাজধানী ইসলামাবাদের আবাসিক এলাকা এবং দেশের পার্বত্য উত্তরাঞ্চলে ব্যাপক আঘাত হেনেছে।

আফগানিস্তান সীমান্ত থেকে ১৫ মাইল দূরে খাইবার পাখতুনখাওয়ার জাবরারাই গ্রামে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত প্রবল বর্ষণের কারণে আকস্মিক বন্যা ও ভূমিধস হয়। এতে অন্তত ১৮ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং অনেকে ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা পড়েছেন বলে জানিয়েছেন জেলা কর্মকর্তা শাহিদ আলি।

উদ্ধারকার্যে সহায়তাকারী শরীফুল্লাহ খান নামে এক সমাজকর্মী জানান, ‘বন্যা যখন আঘাত হানে, তখন গ্রামের সবাই ঘুমিয়ে ছিল।’ ভূমিধসের কারণে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্ধারকারী দলকে পায়ে হেঁটে ওই পার্বত্য এলাকায় পৌঁছাতে হয়েছে।

খাইবার পাখতুনখাওয়ার আরেকটি অংশে, ভারী বৃষ্টি ও ভূমিধসের কারণে মনোরম উপত্যকা সিরান ভ্যালিতে ১,৩০০ জনেরও বেশি পর্যটক ঘণ্টার পর ঘণ্টা আটকা পড়েছিলেন। পরে তাদের উদ্ধার করা হয়।

বিধ্বংসী আকস্মিক বন্যা উত্তর ভারতেও আঘাত হেনেছে, যেখানে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। বৃহস্পতিবার ভারত-নিয়ন্ত্রিত জম্মু ও কাশ্মিরে আকস্মিক বন্যায় অন্তত ৪৪ জন নিহত এবং শতাধিক আহত হয়েছেন। এছাড়া গত ৫ আগস্ট উত্তরাখণ্ড রাজ্যে বন্যার স্রোতে অন্তত চারজনের মৃত্যু হয়।