অবরুদ্ধ গাজায় খাদ্য সংকট, ত্রাণ তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে তুর্কি সংস্থাগুলো

ইসরায়েলের আগ্রাসনের কারণে সৃষ্ট তীব্র খাদ্য সংকট মোকাবিলায় অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের পাশে দাঁড়িয়েছে তুরস্কের বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা। তারা অক্লান্তভাবে এ সংকট নিরসনে কাজ করে যাচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরায়েলি হামলা শুরুর পর থেকে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয় লাঘবে তুরস্কের অসংখ্য ফাউন্ডেশন ও সমিতি নিয়মিতভাবে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয় ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসামগ্রী পাঠিয়ে চলেছে। একই সঙ্গে পরিচ্ছন্নতা কিট, ওষুধ, চিকিৎসা সরঞ্জাম এবং শিশুদের জন্য প্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যও পাঠানো হচ্ছে।

হামলা শুরুর পর থেকে এই নিরবচ্ছিন্ন সহায়তা কার্যক্রমের মূল লক্ষ্য হলো দিন দিন ভয়াবহ হয়ে ওঠা খাদ্য সংকট মোকাবিলা করা।

সহায়তা পাঠানো সংস্থাগুলোর মধ্যে অন্যতম তুর্কি রেড ক্রিসেন্ট ‘সহমর্মিতার জাহাজ’ নামে পাঁচটি মিশন পরিচালনা করেছে। এর মধ্যে ১০টি জাহাজের মাধ্যমে মোট ৮৬৯ ট্রাক (১৫,০৮৯ টন) মানবিক সহায়তা পাঠানো হয়েছে, যার সিংহভাগই ছিল খাদ্য, পরিচ্ছন্নতা সামগ্রী এবং আশ্রয় ও চিকিৎসাসামগ্রী।

ঈদুল আযহা উপলক্ষে গাজার জন্য দান করা কোরবানির পশু থেকে প্রস্তুতকৃত ৫২,১৬৪টি ৮০০ গ্রামের মাংসের কৌটা ফিলিস্তিনি শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘের সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ) এবং তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের (আফাদ) মাধ্যমে গাজায় পৌঁছে দেওয়া হয়। ১২টি কন্টেইনার বোঝাই এই সামগ্রী মিশরের আলেকজান্দ্রিয়া বন্দরে পাঠানোর পর চলতি বছরের ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি গাজায় পৌঁছায়। এছাড়া, তুরস্কের ১৫তম সহায়তা জাহাজে পাঠানো ২৬১ টন কৌটাজাত মাংস গাজায় পৌঁছানোর জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে, যা ওই অঞ্চলে থাকা রেড ক্রিসেন্টের দল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

তুর্কি রেড ক্রিসেন্টের রান্নাঘর উত্তর ও দক্ষিণ গাজায় দৈনিক প্রায় ১৫,০০০ মানুষের খাবার সরবরাহ করে আসছে। এখন পর্যন্ত সংস্থাটি ৬৮ লাখ ৩০ হাজার প্যাকেট গরম খাবার বিতরণ করেছে। গত ১৭ আগস্ট থেকে ফিলিস্তিন রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং স্থানীয় অংশীদারদের সহযোগিতায় খাবার সরবরাহের ক্ষমতা দৈনিক ২১,০০০-এ উন্নীত করা হয়েছে।

সংস্থাটি গাজায় থাকা তাদের দলের মাধ্যমে স্থানীয় বাজার থেকে খাদ্য প্যাকেজ, পরিচ্ছন্নতা কিট ও কম্বলের মতো ৪০০ টন সহায়তা সামগ্রী সংগ্রহ করে বিতরণ করেছে। ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বর থেকে ট্যাঙ্কারের মাধ্যমে গাজায় খাবার পানি বিতরণ শুরু করে সংস্থাটি। প্রতিটি পরিবারকে ২০ লিটার করে দৈনিক মোট ২০ টন পানি সরবরাহ করা হয়। এ পর্যন্ত ১৬ লাখ ৬০ হাজার লিটার খাবার পানি সরবরাহ করা হয়েছে এবং পরিস্থিতি অনুকূলে এলে পুনরায় বিতরণ শুরু হবে।

দেনিজ ফেনেরি অ্যাসোসিয়েশন উত্তর, দক্ষিণ ও মধ্য গাজায় স্থাপিত ১০টি রান্নাঘরের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫,০০০ মানুষকে গরম খাবার সরবরাহ করছে। অবকাঠামো সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাওয়ায় গাজার অন্যতম গুরুতর সমস্যা—পানির সংকট মোকাবিলায় সংস্থাটি প্রতিদিন ১৫ টন বিশুদ্ধ খাবার পানি বিতরণ করছে এবং দুটি পানির কূপ সচল রেখেছে। এছাড়াও, সংস্থাটি গাজার আল-ওয়াফা হাসপাতালে রোগী ও তাদের পরিচর্যাকারীদের জন্য দিনে তিন বেলা খাবার সরবরাহ করছে।

হামলা শুরুর পর থেকে আইএইচএইচ ह्यूম্যানিটারিয়ান রিলিফ ফাউন্ডেশন এ অঞ্চলে ৩ কোটি ৫১ লাখ ৯০ হাজার প্যাকেট গরম খাবার বিতরণ করেছে। সংস্থাটি ১২ কোটি ৭৬ লাখ ৩০ হাজার রুটি এবং কৌটাজাত খাবার, পাস্তা, প্রস্তুত খাবারের প্যাকেট ও ফলের রসসহ ১২ লাখ বিভিন্ন ধরনের খাদ্যসামগ্রী সরবরাহ করেছে। পাশাপাশি ২ লাখ ৬ হাজার ৫২১টি খাদ্য পার্সেল, ১ লাখ ২৯ হাজার ৭৮৯ বস্তা ময়দা এবং ১৭,৮৪৮টি সবজির প্যাকেজও বিতরণ করা হয়েছে।

জানসুইউ অ্যাসোসিয়েশন হামলা শুরুর পর থেকে খাদ্য পার্সেল, ময়দা, চাল, তেল, ডাল, পাস্তাসহ অন্যান্য জরুরি খাদ্যসামগ্রী বোঝাই মোট ১০২ ট্রাক সহায়তা পাঠিয়েছে। এখন পর্যন্ত সংস্থাটি মোট ১,২৭৩ টন খাদ্যসামগ্রী গাজার বাইরে থেকে সরবরাহ করেছে এবং জরুরি মানবিক সহায়তা বোঝাই তাদের ২০টি ট্রাক সীমান্ত পারাপারের অপেক্ষায় রয়েছে।

ইস্তাম্বুল-ভিত্তিক ফেডারেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাসোসিয়েশনস (আইডিডিইএফ) ৪০ লাখ গরম খাবার, ২ লাখ খাদ্য, ফল-সবজি ও পরিচ্ছন্নতার পার্সেল, ৩ লাখ ৫০ হাজার প্যাকেট রুটি এবং ৩২০ টন ময়দা সরবরাহ করেছে। ফেডারেশনটি মিশর ও জর্ডানে থাকা তাদের গুদাম থেকে ২০৪ ট্রাক সহায়তা পাঠিয়েছে এবং আফাদের সমন্বয়ে পরিচালিত তিনটি ত্রাণ জাহাজে আট ট্রাক ত্রাণসামগ্রী দিয়ে অবদান রেখেছে।

ডক্টরস ওয়ার্ল্ডওয়াইড ৭ অক্টোবরের পর থেকে গাজার ৪৩,০০০-এর বেশি পরিবার এবং ৯ লাখের বেশি মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য ও পরিচ্ছন্নতা সহায়তা প্রদান করেছে। আল-শিফা, আল-আকসা এবং আল-আহলি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা দেওয়ার পাশাপাশি ইউনিসেফের সহযোগিতায় উত্তরে একটি শিবিরে স্বাস্থ্যকেন্দ্র স্থাপন করে শিশু ও গর্ভবতী নারীদের টিকা ও ফর্মুলা দুধ দিচ্ছে সংস্থাটি।

সাদাকাৎসি অ্যাসোসিয়েশন হামলা শুরুর পর থেকে গাজায় প্রায় ২০ লাখ মানুষকে স্বাস্থ্যসেবা, খাদ্য, আশ্রয় ও জরুরি সহায়তা দিয়েছে। সংস্থাটি হাসপাতালে ছয়টি অ্যাম্বুলেন্স ও হাজার হাজার বাক্স ওষুধ সরবরাহ করেছে, দুটি তাঁবুর শহরে ১,০০০ পরিবার এবং দুটি তাঁবুর বিদ্যালয়ে ৪০০ শিক্ষার্থীর আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেছে।

উল্লেখ্য, তুরস্ক-ফিলিস্তিন মানবিক সহায়তা কার্যক্রমের আওতায় ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবরের পর থেকে আফাদের সমন্বয়ে তুরস্কের মেরসিন বন্দর থেকে মিশরের আল-আরিশ বন্দরে ১৬টি ত্রাণবাহী জাহাজ পাঠানো হয়েছে।