গাজায় তিন ধরনের যুদ্ধ চলছে, ইস্তাম্বুল সম্মেলনে আলেমদের হুঁশিয়ারি

ফিলিস্তিনের গাজায় চলমান গণহত্যা মোকাবেলায় মুসলিম বিশ্বের করণীয় নির্ধারণে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হচ্ছে। সম্মেলনের অংশ হিসেবে রোববার দিনব্যাপী এক কর্মশালায় বক্তারা সতর্ক করে বলেছেন, গাজা কেবল সামরিক আগ্রাসনের শিকার নয়, বরং সেখানে তিন ধরনের যুদ্ধ চলছে।

ইস্তাম্বুলের ডেমোক্রেসি অ্যান্ড ফ্রিডম আইল্যান্ডে অনুষ্ঠিত এই কর্মশালায় আলেম, রাষ্ট্র প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, গণমাধ্যমকর্মী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা বিভিন্ন দলে ভাগ হয়ে ফিলিস্তিনিদের সহায়তায় বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ এবং মুসলিম বিশ্বে ঐক্য জোরদার করার উপায় নিয়ে আলোচনা করেন। সকালের অধিবেশনে ইসলামি আলেম ও সরকারগুলোর দায়িত্ব নিয়ে আলোচনা হয়। পরবর্তী অংশে পুনর্গঠন প্রকল্পে ব্যবসায়ীদের ভূমিকা এবং বৈশ্বিক সচেতনতা বৃদ্ধিতে গণমাধ্যমের করণীয় বিষয়ে আলোকপাত করা হয়।

বিকেলে অনুষ্ঠিত একটি বিশেষ অধিবেশনে সংঘাতের রাজনৈতিক দিক এবং মুসলিম ঐক্যকে এগিয়ে নেওয়ার কৌশল নিয়ে আলোচনা হয়। কোরআনের নির্দেশনা ‘আল্লাহর রজ্জু দৃঢ়ভাবে আঁকড়ে ধরো এবং বিভক্ত হয়ো না’—এর ওপর ভিত্তি করে এই আলোচনা পরিচালিত হয়।

গাজায় ‘তিন ধরনের যুদ্ধ’ চলছে

দিন শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস (আইইউএমএস) জানায়, গাজা কেবল সামরিক আগ্রাসনের শিকার নয়, বরং এটি মানবতা, ন্যায়বিচার, স্বাধীনতা ও মর্যাদার মূল্যবোধের ওপরও একটি আঘাত।

একটি যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়, গাজা উপত্যকা বর্তমানে ‘তিন ধরনের যুদ্ধের’ অধীনে রয়েছে। এগুলো হলো—নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ, নিরীহ মানুষকে অনাহারে রাখা ও অবরোধ করা এবং আরব, ইসলামি ও আন্তর্জাতিক বিশ্বের নীরবতার মাধ্যমে অপমানিত করা।

মুসলিম বিশ্বের জন্য এই মুহূর্তটিকে একটি ‘প্রকৃত পরীক্ষা’ হিসেবে উল্লেখ করে আলেমরা সতর্ক করেন, ‘গাজা ও জেরুজালেমের বিষয়টি শুধু প্রত্যেক মুসলমানের বিশ্বাস ও সম্মানের বিষয় নয়, বরং এটি প্রত্যেক মুক্তিকামী মানুষের জন্য একটি সর্বজনীন মানবিক দায়িত্ব।’

বিবৃতিতে ইসরায়েলকে সরাসরি উদ্দেশ্য করে বলা হয়, ‘আমরা নেতানিয়াহুকে বলতে চাই, গাজায় এই বর্বরতা অব্যাহত রাখার অর্থ হলো উম্মাহর ধৈর্যের পরীক্ষা নেওয়া এবং এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। মুসলিম উম্মাহর হৃদয়ে জমে থাকা ক্রোধ একসময় পুরো ইসলামি বিশ্বে ব্যাপক গণআন্দোলনে রূপ নেবে।’

মুসলিম সরকারগুলোর দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে আলেমরা বলেন, ‘নীরবতা হলো বিশ্বাসঘাতকতা, বিশ্বাসঘাতকতা থেকে জন্মায় ক্রোধ, আর ক্রোধ থেকেই জাগরণ ঘটে।’

তুরস্ক সব উপায়ে সহযোগিতা করছে

আন্তর্জাতিক জেরুজালেম প্রতিষ্ঠানের তুরস্ক শাখার প্রধান আইমেন জেইদান আনাদোলুকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, জেরুজালেম ও গাজার জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ে তুরস্কের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলেন, ‘তুরস্ক সব উপায়ে ফিলিস্তিন ও জেরুজালেমকে সমর্থন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’

তিনি আরও সতর্ক করে বলেন, ‘জেরুজালেমের পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন। সেখানে মসজিদ আল-আকসা নিশ্চিহ্ন করার যুদ্ধ চলছে।’ তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ইহুদি উৎসবের সময় মসজিদে অভিযান আরও বাড়বে।

মূল সমস্যা ইচ্ছার, ভাবনার নয়

রাজনৈতিক ঘোষণার বাইরে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ সম্পর্কে জানতে চাইলে জেইদান জোর দিয়ে বলেন, মুসলিম দেশগুলোকে অবশ্যই ভাবনাগুলোকে কাজে পরিণত করতে হবে। তিনি বলেন, ‘সমস্যাটি ভাবনা বা বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার নয়, সমস্যাটি হলো ইচ্ছার।’

বেসামরিক নাগরিকদের দুর্দশার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে নিহতদের ৮০ শতাংশই বেসামরিক নাগরিক। তিনি বলেন, ‘আজ তারা গাজায় একটি সাধারণ তাঁবুতে তিনটি ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা চালাচ্ছে। এর চেয়ে বিকারগ্রস্ত আর কী হতে পারে? এটি আমাদের সবার জন্য লজ্জার।’

এই সম্মেলনকে অর্থবহ উদ্যোগে রূপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়ে জেইদান বলেন, ‘আমরা যদি শুধু আলোচনা সভা করতে থাকি, হোটেলের ভেতরে কথা বলি এবং এই যুদ্ধ বন্ধে কোনো কার্যকর পদক্ষেপ না নিই, তাহলে গাজার ভাইয়েরাও আমাদের অভিযুক্ত করবে।’

আট দিনব্যাপী ‘ইসলামিক অ্যান্ড হিউম্যানিটারিয়ান রেসপনসিবিলিটি: গাজা’ শিরোনামের এই সম্মেলনটি যৌথভাবে আয়োজন করেছে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন অব মুসলিম স্কলারস (আইইউএমএস) এবং ফাউন্ডেশন ফর ইসলামিক স্কলারস ইন তুরস্ক। এতে ৫০টিরও বেশি দেশের ১৫০ জনের বেশি আলেম ও প্রতিনিধি অংশ নিয়েছেন। শুক্রবার ইস্তাম্বুলের আইয়ুব সুলতান মসজিদে প্রার্থনার মাধ্যমে সম্মেলনটি শুরু হয় এবং আগামী ২৯ আগস্ট হাইয়া সোফিয়া গ্র্যান্ড মসজিদে ‘ইস্তাম্বুল ঘোষণা’ প্রকাশের মাধ্যমে শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।