তিব্বতের বাঁধ ঘিরে উত্তাপ: অরুণাচলে পানিযুদ্ধের আশঙ্কায় ভারত

তিব্বতে বিশ্বের বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ বাঁধ নির্মাণের একটি ঘোষণাই ভারতের পুরনো উদ্বেগ ফিরিয়ে এনেছে। কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী চীন ব্রহ্মপুত্র নদের পানিকে ‘অস্ত্র’ হিসেবে ব্যবহার করতে পারে—এমন আশঙ্কায় দিল্লি এখন অরুণাচল প্রদেশে নিজেদের একটি বিতর্কিত মেগা-বাঁধ প্রকল্পকে দ্রুত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।

ইয়ারলুং জাংবো নামে পরিচিত নদটি তিব্বতের অঙ্গসি হিমবাহ থেকে উৎপন্ন হয়ে ভারতে সিয়াং ও পরে ব্রহ্মপুত্র নামে প্রবেশ করেছে। এই নদের ওপর চীনের প্রস্তাবিত বাঁধটি ভারতের সীমান্তে প্রবেশের ঠিক আগে তৈরি হবে। গত ডিসেম্বরে চীনের এই ঘোষণার পরই নরেন্দ্র মোদির সরকার নড়েচড়ে বসে।

ভারত সরকারের একটি অভ্যন্তরীণ বিশ্লেষণে দেখা গেছে, চীনের প্রকল্পটি সম্পন্ন হলে তারা প্রায় ৪০ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি সরাতে পারবে, যা ভারতের প্রাপ্য পানির এক-তৃতীয়াংশের বেশি। এর ফলে শুষ্ক মৌসুমে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে পানিপ্রবাহ প্রায় ৮৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এই সম্ভাব্য বিপর্যয় ঠেকাতে ভারত তার বৃহত্তম পানিবিদ্যুৎ কোম্পানিকে দিয়ে আপার সিয়াং মাল্টিপারপাস স্টোরেজ ড্যাম প্রকল্পের কাজ পুনরায় শুরু করিয়েছে। গত মে মাসে সশস্ত্র পুলিশের পাহারায় জরিপ সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয় প্রকল্প এলাকায়।

ভারতের প্রস্তাবিত আপার সিয়াং বাঁধ প্রায় ১৪ বিলিয়ন ঘনমিটার পানি ধরে রাখতে সক্ষম হবে, যা শুষ্ক মৌসুমে ছেড়ে দিয়ে চীনের তৈরি করা সম্ভাব্য সংকট মোকাবিলা করা যাবে। যেমন, গুয়াহাটিতে পানির ঘাটতি ২৫ শতাংশ থেকে ১১ শতাংশে নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। এছাড়া, বাঁধটি আংশিক খালি রাখলে চীন হঠাৎ অতিরিক্ত পানি ছাড়লেও বন্যার ঝুঁকি শোষণ করা যাবে।

তবে এই প্রকল্পের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে অরুণাচলের স্থানীয় আদিবাসী সম্প্রদায়। তাদের আশঙ্কা, বাঁধটি নির্মিত হলে অন্তত ১৬টি গ্রাম ডুবে যাবে এবং প্রায় ১০ হাজার মানুষ সরাসরি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ধান, কমলা, মাল্টা ও এলাচ চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করা এই মানুষেরা বলছেন, এর প্রভাব পড়বে এক লাখের বেশি মানুষের জীবনে। দুই সন্তানের মা ওডনি পালো পাবিন বলেন, ‘এই জমিতে আমাদের এলাচ, ধান, কাঁঠাল আর নাশপাতি আমাদের সন্তানদের শিক্ষার খরচ জোগায়। আমরা মরে গেলেও এই বাঁধ হতে দেবো না।’

গত মে মাসে প্রকল্পের কর্মীরা জরিপ করতে গেলে পারং গ্রামের বাসিন্দারা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা মেশিনপত্র ভাঙচুর করে, একটি সেতু ধ্বংস করে এবং পুলিশের ক্যাম্পে লুটপাট চালায়। আদিবাসী সম্প্রদায়গুলো গ্রামীণ সড়কে পাহারা বসিয়েছে, যাতে প্রকল্পের কর্মীরা সেখানে ঢুকতে না পারে।

যদিও অরুণাচলের মুখ্যমন্ত্রী, যিনি মোদির দলেরই সদস্য, এই প্রকল্পকে সমর্থন করে একে চীনের ‘অস্তিত্বের হুমকি’ মোকাবিলার উপায় হিসেবে দেখছেন। রাজ্য সরকার ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সঙ্গে ক্ষতিপূরণ নিয়ে আলোচনা শুরু করেছে। তবে স্থানীয় এমপি আলো লিবাং মনে করেন, পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিলে মানুষকে রাজি করানো সম্ভব হতে পারে।

চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অবশ্য দাবি করেছে, তাদের প্রকল্পগুলো কঠোর বৈজ্ঞানিক পরীক্ষার পর অনুমোদন পেয়েছে এবং ভাটির দেশগুলোর কোনো ক্ষতি করবে না। তারা ভারত ও বাংলাদেশের সঙ্গে দীর্ঘকাল ধরে যোগাযোগ ও সহযোগিতা বজায় রাখার কথাও জানিয়েছে। অন্যদিকে, ভারতও পাকিস্তানের সঙ্গে পানি বণ্টন চুক্তি নিয়ে বিতর্কে জড়িয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, ভূমিকম্পপ্রবণ তিব্বত ও অরুণাচলের মতো অঞ্চলে এত বড় বাঁধ নির্মাণ অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার গবেষক সায়নাংশু মডক জানান, এই অঞ্চলে ভূমিধস ও হিমবাহ হ্রদ ফেটে বন্যার ঝুঁকি রয়েছে। সব মিলিয়ে, দুই দেশের এই বাঁধ প্রতিযোগিতা পুরো অঞ্চলের জন্য একটি বড় ধরনের পরিবেশগত ও মানবিক সংকট তৈরি করতে পারে।