তুর্কি বিশেষজ্ঞ: ‘দাবানল কেবল বনভূমি নয়, সাগর-নদীর জন্যও মারাত্মক হুমকি’

দাবানল কেবল বনভূমিই ধ্বংস করে না, এটি সাগর ও নদীর জন্যও মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করে। এর ফলে সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্র দীর্ঘস্থায়ী ক্ষতির শিকার হয় বলে তুরস্কের একজন বিশেষজ্ঞ সতর্ক করেছেন।

চানাক্কালে অনসেকিজ মার্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের সামুদ্রিক জীববিজ্ঞানী এবং জলজ বাস্তুতন্ত্র সুরক্ষা সমিতির সভাপতি হেরদেম আসলান আনাদোলু সংবাদ সংস্থাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে জানান, তুরস্কে দাবানলের পর মূল মনোযোগ থাকে স্থলভাগের ক্ষয়ক্ষতির দিকে, কিন্তু জলজ বাস্তুতন্ত্রও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

আসলান জানান, ২০২১ সালে মারমারিসের দাবানলের দেড় বছর পর তিনি সাগরের গভীরে ডুব দিয়ে দেখতে পান, সমুদ্রতল পলিতে ঢেকে গেছে। এই পলি সব ধরনের সামুদ্রিক জীবের আলো ও অক্সিজেন পাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল, যার ফলে তাদের দম বন্ধ হয়ে যায়। তিনি বলেন, ‘আমি লক্ষ্য করেছি, অনেক প্রাণী মারা গেছে। বিশেষ করে সমুদ্রের তলদেশে বসবাসকারী প্রবাল, স্পঞ্জ এবং সামুদ্রিক ঘাসের মতো নিশ্চল জীবগুলো আক্ষরিক অর্থেই জীবন্ত কবরস্থ হয়েছিল। এটি এমন এক ঘটনা, যার প্রভাব বছরের পর বছর ধরে লক্ষ্য করা যায়।’

লোহার কণা ও অক্সিজেনের ঘাটতি

আসলান সতর্ক করে বলেন, বাতাস বা নদীর মাধ্যমে ভেসে আসা ছাইয়ের মধ্যে থাকা লোহার কণা আরেকটি বিপদ তৈরি করে। এই উপাদানটি সাগরে বসবাসকারী অণুজীবদের মধ্যে সালোকসংশ্লেষণ বাড়িয়ে দেয়। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন—এক প্রকার আণুবীক্ষণিক জীব যা লবণাক্ত ও স্বাদু উভয় পানিতে পাওয়া যায় এবং আমাদের প্রতি দুটি শ্বাসের একটির জন্য দায়ী—এই সারের প্রভাবে অতিরিক্ত পরিমাণে বংশবৃদ্ধি করে। ফাইটোপ্ল্যাঙ্কটন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জুপ্ল্যাঙ্কটনও বাড়ে, যা মাছের লার্ভার খাবার হতে পারে।

প্রথম দৃষ্টিতে এটিকে উপকারী মনে হলেও দীর্ঘ মেয়াদে তা ক্ষতিকর, কারণ এই ধরনের বায়োমাসের বৃদ্ধি সমুদ্রে অক্সিজেনের ঘাটতি তৈরি করে। আসলান আরও জানান, ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ার ভয়াবহ দাবানলের পর বিপুল পরিমাণ লোহা সমুদ্রে মিশে যাওয়ায় সামুদ্রিক জীবের গণমৃত্যু হয়েছিল।

ব্ল্যাক কার্বন ও জলবায়ু পরিবর্তন

আসলান বলেন, দাবানলের ফলে ‘ব্ল্যাক কার্বন’ও নির্গত হয়, যা উচ্চ তাপমাত্রায় জৈব যৌগ পোড়ার ফলে তৈরি হয়। এটি জলবায়ু পরিবর্তনের একটি প্রধান চালক। তার বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে পৌঁছে যাওয়া আগুনে ঝলসে যাওয়া গাছগুলোর কথা স্মরণ করে তিনি জানান, পোড়া গাছ থেকে ‘ব্ল্যাক কার্বন’ নামক একটি পদার্থ তৈরি হয়। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে দাবানলের কারণে প্রতি বছর প্রায় ৪ থেকে ২৫ কোটি টন ব্ল্যাক কার্বন উৎপন্ন হয়। এটিও নদী ও বৃষ্টির মাধ্যমে সাগর-মহাসাগরে পৌঁছায়।

তিনি যোগ করেন, ব্ল্যাক কার্বন সামুদ্রিক জীবের ওপর একটি আস্তরণ তৈরি করে, যার ফলে তাদের মৃত্যু হয়। পরিচিত সামুদ্রিক পলির প্রায় ৬ শতাংশই ইতোমধ্যে এই উপাদান দিয়ে গঠিত। তবে জলবায়ু পরিবর্তন, মানুষের অবহেলা এবং অপর্যাপ্ত সতর্কতার কারণে দাবানল বাড়তে থাকলে এই সংখ্যা আশঙ্কাজনকভাবে বেড়ে যাবে। গবেষণায় দেখা গেছে, দাবানলের পর প্রবাল প্রাচীরের শতভাগ মৃত্যু হয় এবং সামুদ্রিক ঘাসের পরিমাণ কমে যায়।

চানাক্কালে প্রণালীতে প্রভাব

চানাক্কালে প্রণালীর কাছে আগুনের সম্ভাব্য প্রভাব সম্পর্কে বলতে গিয়ে আসলান বলেন, এখানকার শক্তিশালী স্রোত দূষণ জমা হওয়াকে সীমিত করতে পারে, কিন্তু ক্ষতি পুরোপুরি দূর করতে পারবে না। ভূমধ্যসাগরের নিম্ন স্রোত মারমারা সাগরে এবং কৃষ্ণ সাগরের ওপরের স্রোত এজিয়ান সাগরে প্রবাহিত হয়। এই স্রোতের কারণে দাবানল থেকে উৎপন্ন ব্ল্যাক কার্বন এবং লোহার কণা হয়তো প্রণালীতে বেশি পরিমাণে জমতে পারবে না, কিন্তু এর প্রভাব ঠিকই থাকবে। তিনি আরও জানান, প্রণালীতে বেন্থিক জীবের জীববৈচিত্র্য সম্পর্কে তাদের কাছে দুর্যোগ-পূর্ব তথ্য রয়েছে, যা ভবিষ্যতের গবেষণার মাধ্যমে তুলনার কাজে ব্যবহার করা যাবে।