জরিপ: দেশে প্রতি ৪ নারীর তিনজনই নির্যাতিত

বাংলাদেশে প্রতি চারজন নারীর মধ্যে তিনজনই জীবনের কোনো না কোনো পর্যায়ে স্বামী বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে শারীরিক, যৌন, মানসিক বা অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। এমন উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে নতুন এক জাতীয় জরিপে।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ও জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের (ইউএনএফপিএ) যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত ‘নারীর প্রতি সহিংসতা জরিপ ২০২৪’ এর পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন সোমবার (১৩ অক্টোবর) রাজধানী ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রকাশ করা হয়। এটি দেশে নারীর প্রতি সহিংসতা বিষয়ে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় জরিপ বলে জানিয়েছে বিবিএস।

জরিপে দেখা গেছে, ৭৬ শতাংশ নারী জীবনে অন্তত একবার স্বামী বা ঘনিষ্ঠ সঙ্গীর হাতে কোনো না কোনো ধরনের সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৪৯ শতাংশ নারী গত এক বছরের মধ্যেই এমন নির্যাতনের মুখোমুখি হয়েছেন। শারীরিক বা যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন ৫৪ শতাংশ নারী, এবং এর মধ্যে ৬০ শতাংশের ক্ষেত্রে ঘটনাগুলো একাধিকবার ঘটেছে।

গর্ভাবস্থাতেও সহিংসতা থামেনি ৭ দশমিক ২ শতাংশ নারী জানিয়েছেন শারীরিক ও ৫ দশমিক ৩ শতাংশ যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এসব ঘটনা মা ও নবজাতকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ায় বলে প্রতিবেদনে সতর্ক করা হয়েছে।

সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয়, ৬২ শতাংশ নারী কখনো কারও কাছে নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেননি। মাত্র ১৪ দশমিক ৫ শতাংশ নারী চিকিৎসা সহায়তা নিয়েছেন, এবং স্বামীর হাতে নির্যাতিতদের মধ্যে ৭ দশমিক ৪ শতাংশ আইনি পদক্ষেপ নিলেও অধিকাংশই স্থানীয় জনপ্রতিনিধি বা সমাজের প্রভাবশালীদের কাছে অভিযোগ করেছেন, আনুষ্ঠানিক আইনি প্রক্রিয়ার বদলে।

অন্যদিকে স্বামী বা সঙ্গী নয় এমন পরিচিত ব্যক্তিদের হাতে ১৫ শতাংশ নারী শারীরিক সহিংসতা ও ২ দশমিক ২ শতাংশ নারী যৌন সহিংসতার শিকার হয়েছেন। এদের অধিকাংশই নিকট আত্মীয়, বন্ধু বা পরিচিত কেউ।

প্রতিবেদনে নতুন করে প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতা (টেক-বেসড ভায়োলেন্স)এর দিকেও দৃষ্টি দেওয়া হয়েছে। দেখা গেছে, ৮ দশমিক ৩ শতাংশ নারী অনলাইন ব্ল্যাকমেইল, ব্যক্তিগত ছবি অপব্যবহার, কিংবা ডিজিটাল নজরদারির শিকার হয়েছেন।

জরিপে দেখা যায়, পণপ্রথা, স্বামীর মাদকাসক্তি, পরকীয় সম্পর্ক, এবং বস্তি এলাকায় বসবাস এসব কারণ নারীর প্রতি সহিংসতার ঝুঁকি বহুগুণ বাড়ায়। বিপরীতে, উচ্চশিক্ষিত স্বামীদের মধ্যে সহিংস আচরণের প্রবণতা তুলনামূলকভাবে কম পাওয়া গেছে।

বিবিএসের মহাপরিচালক মোহাম্মদ মিজানুর রহমান প্রতিবেদনের উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় ও নির্ভরযোগ্য জরিপ, যা নারীর জীবনে সহিংসতার প্রকৃতি, ধরন ও প্রভাব সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য দিয়েছে। ভবিষ্যৎ নীতিনির্ধারণে এটি বড় ভূমিকা রাখবে।

তিনি আরও বলেন, বিবিএস আগামীতে নারী ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতা বিষয়ক তথ্য সংগ্রহের সক্ষমতা আরও জোরদার করবে।
পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য ড. কায়ুম আরা বেগম প্রধান অতিথি হিসেবে প্রতিবেদনটি উন্মোচন করেন।

অনুষ্ঠানে ইউএনএফপিএ বাংলাদেশের প্রতিনিধি ক্যাথরিন ব্রিন কামকং বলেন, এই পরিসংখ্যানগুলো বাংলাদেশের নারীদের বাস্তব জীবনের প্রতিফলন। এখন প্রয়োজন রূপান্তরমূলক উদ্যোগ, যাতে সহিংসতা রোধ, বেঁচে থাকা নারীদের সহায়তা ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যায়।

আলোচনায় নারী বিষয়ক সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান শিরিন হক, ডিআইজি ড. শোভা রিয়াজ আলম, এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নারী ও লিঙ্গ অধ্যয়ন বিভাগের অধ্যাপক ড. সানজিদা আখতার অংশ নেন। তারা বলেন, প্রমাণভিত্তিক নীতি সংস্কার ও সামাজিক সচেতনতা ছাড়া নারীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।

তাদের মতে, নারীর প্রতি সহিংসতা শুধু অপরাধ নয়, এটি উন্নয়ন ও মানবাধিকারেরও বড় বাধা।