শুধু অবকাঠামো নয়, আপনার ফোন থেকে গাড়ি পর্যন্ত যেভাবে প্রভাব ফেলছে চীন

বাংলাদেশে চীনের বিনিয়োগ ও প্রযুক্তিগত সহায়তা এক নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। বাণিজ্য থেকে শুরু করে প্রযুক্তি, প্রায় প্রতিটি খাতে এই দুই দেশের অংশীদারত্ব গভীর হচ্ছে, যা দেশের অর্থনীতিতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বর্তমানে প্রায় এক হাজার চীনা প্রতিষ্ঠান দেশের পোশাক, বিদ্যুৎ, তথ্যপ্রযুক্তি এবং নির্মাণ খাতে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে।

দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগের (এফডিআই) অন্যতম প্রধান কেন্দ্র হয়ে উঠেছে বাংলাদেশ। ২০২৪ সাল নাগাদ এই বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় ১ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। এই ধারাকে আরও গতিশীল করেছে নতুন নতুন কারখানা স্থাপন। সম্প্রতি চট্টগ্রাম ইপিজেডে ৩০ মিলিয়ন ডলার ব্যয়ে একটি হেডফোন ও ডেটা ক্যাবল কারখানা তৈরি করছে চীনা প্রতিষ্ঠান ডিরেকশন টেকনোলজি, যেখানে প্রায় ৪৭৮ জন স্থানীয় কর্মীর কর্মসংস্থান হবে। এছাড়া চায়না লেসো গ্রুপ প্রায় ৩২ কোটি ৭৭ লাখ ডলার বিনিয়োগে আরেকটি নতুন কারখানা স্থাপন করছে, যা ৫০০ থেকে ৬০০ মানুষের কাজের সুযোগ তৈরি করবে।

দুই দেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কও প্রায় ২৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে, যা অত্যন্ত শক্তিশালী। তবে বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের কাঁচামাল, যন্ত্রপাতি এবং প্রযুক্তিপণ্যের জন্য চীনের ওপর নির্ভরতা অনেক বেশি। এই বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে এবং বাংলাদেশি পণ্যের রপ্তানি বাড়াতে ২০২০ সালে চীন একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ নেয়। ওই বছর বাংলাদেশের ৯৭ শতাংশ পণ্যের জন্য শুল্কমুক্ত সুবিধা ঘোষণা করা হয়। এর ফলে পাটজাত পণ্য, কৃষিপণ্য ও ওষুধের মতো খাতে বাংলাদেশের রপ্তানি বাড়ছে এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য চীনা বাজারে প্রবেশের নতুন সুযোগ তৈরি হয়েছে।

দেশের প্রযুক্তি খাতে চীনের প্রভাব আরও গভীর। গ্রামীণফোন ছাড়া প্রায় সব মোবাইল অপারেটরই হুয়াওয়ে ও জেডটিই-এর মতো চীনা প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। স্মার্টফোন বাজারেও অপো, ভিভো, শাওমি ও রিয়েলমির মতো চীনা ব্র্যান্ডগুলো সাশ্রয়ী মূল্য, আধুনিক ডিজাইন এবং উন্নত ক্যামেরার সুবাদে শীর্ষস্থান দখল করেছে। স্থানীয়ভাবে স্মার্টফোন সংযোজন কারখানা স্থাপিত হওয়ায় পণ্যের দাম কমার পাশাপাশি কর্মসংস্থানও বেড়েছে।

প্রযুক্তিগত এই অংশীদারত্ব এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই), গেমিং এবং বৈদ্যুতিক গাড়ির (ইভি) মতো নতুন খাতেও প্রসারিত হচ্ছে। চীনের অন্যতম বৃহৎ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় গেম শিল্পের উন্নয়নে কাজ করতে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। প্রতিষ্ঠানটির এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের পাবলিক অ্যাফেয়ার্স প্রধান ইয়ে লার লাউ জানান, ‘গেম কেবল বিনোদন নয়, এটি একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক খাত।’ অন্যদিকে, বিশ্বের বৃহত্তম ইভি নির্মাতা বিওয়াইডি বাংলাদেশের বাজারে প্রবেশ করে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ২৫০টির বেশি গাড়ি বিক্রি করেছে এবং দেশজুড়ে চার্জিং স্টেশন তৈরির পরিকল্পনা করছে।

প্রযুক্তিবিদরা মনে করেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ থেকে ‘এআই স্মার্ট বাংলাদেশে’ রূপান্তরের ক্ষেত্রে চীন একটি অনুসরণযোগ্য মডেল হতে পারে। তাদের মতে, শিল্প, কৃষি, স্বাস্থ্যসেবা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় এআই-এর ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এই লক্ষ্য অর্জনে বিশেষজ্ঞরা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণাধর্মী এআই ল্যাব স্থাপন এবং স্কুল পর্যায় থেকে প্রোগ্রামিং ও কোডিং শিক্ষা চালুর ওপর জোর দিচ্ছেন।

চীন থেকে ইলেকট্রনিক পণ্য আমদানিকারক সৈয়দ মেহেদী হাসান জানান, পণ্যের বৈচিত্র্য ও কম দামের কারণে দেশের ক্রেতাদের কাছে সুলভ মূল্যে মানসম্মত পণ্য পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) কর্মকর্তারাও মনে করেন, দুই দেশের ৫০ বছরের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক এখন প্রযুক্তি, উৎপাদন ও উদ্ভাবনের এক বিশাল উৎসে পরিণত হয়েছে, যা বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।